বন্ধের দিন সকালে শিলিগুড়িতে একটি এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। — বিশ্বরূপ বসাক
শনি-রবিবার ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। সোমবার মানুষ অপেক্ষা করেছিল, ব্যাঙ্কে হয়তো টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল, কোথাও সাটার নামিয়ে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও ব্যাঙ্ক খোলার আগে মাথা পিছু টাকা দেওয়ার শর্ত দিতে হল কর্তৃপক্ষকে। কোথাও এটিএমের সাটার খোলা থাকলেও স্ক্রিনে ভেসে আসছে ‘আউট অফ ক্যাশ’। সেই এটিএমেই বার বার কার্ড ‘এন্ট্রি’, ‘রি এন্ট্রি’ করে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। রায়গঞ্জ থেকে কোচবিহার এমনই অবস্থা।
শর্তে খুলল ব্যাঙ্ক
তিনশো নয়, দুহাজার টাকা করে গ্রাহক পিছু এ দিন দেওয়া হবে এই শর্তেই খুলল ব্যাঙ্ক। টানা চার দিন বন্ধ ছিল ইংরেজবাজার ব্লকের কাজিগ্রামের বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কের শাখাটি। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুশীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুক্রবার বিকেলের দিকে আমরা কিছু টাকা ব্যাঙ্কের রিজিওনাল দফতর থেকে পেয়েছিলাম। মাঝে শনি ও রবি ব্যাঙ্ক ছুটি ছিল। এ দিন দুহাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলেই ব্যাঙ্ক খোলা গিয়েছে। প্রায় তিনশো জনকে এদিন টাকা দিয়ে পারা গিয়েছে। কাল কী হবে জানি না।’’ গ্রাহকদের অভিযোগ, এদিন ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ ও ২০ টাকার নোট দেওয়া হলেও সেগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। বাজারে চালাতে মুশকিল হবে। ম্যানেজার বলেন, তাঁরা যে নোট পেয়েছেন, সেটাই দিয়েছেন।
সিতাইয়ে ক্ষুব্ধ বিধায়ক
কোচবিহার জেলায় ১৬৪ টি এটিএম কাউন্টার রয়েছে। এর মধ্যে একটা বড় অংশের এটিএম রয়েছে শহরের বাইরে। দিনহাটা যাওয়ার পথে ঘুঘুমারি, দেওয়ানহাট, ভেটাগুড়ি থেকে শুরু করে বলরামপুর, সিতাই, শীতলখুচি সহ মাথাভাঙা, মেখলিগঞ্জ, তুফানগঞ্জের বহু এলাকাতেই এটিএম কাউন্টার রয়েছে। ভেটাগুড়ির বাসিন্দা রাজীব বর্মন জানান, ভেটাগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় তিনটি এটিএম কাউন্টার রয়েছে। যার কোনওটিতেই পাঁচশ, হাজারের নোট বাতিল হওয়ার পর থেকে টাকা থাকছে না। বাধ্য হয়ে তাঁদের কোচবিহার শহরে যেতে হচ্ছে। সিতাইয়ের বিধায়ক জগদীশ বসুনিয়া বলেন, “আমাদের এলাকায় মাত্র কয়েকটি এটিএম। সেগুলিতে আবার টাকা থাকে না। ব্যাঙ্কে দাঁড়িয়েও অনেকে টাকা পাচ্ছে না। তাই অনেকেই জেলা শহরে গিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। তার পরেও কেউ চাহিদা মতো টাকা পাচ্ছেন না।”
অবরোধ কালিয়াচকে
মালদহে সপ্তাহখানেক ধরেই ঝাঁপ বন্ধ হয়ে রয়েছে এটিএম গুলির। দু’দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় টান পড়েছে খুচরো নোটের জোগানে। তাই সোমবার কাকভোরে মালদহের কালিয়াচক থানা রোডের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন গ্রাহকেরা। এ দিন সকাল দশটা নাগাদ ব্যাঙ্ক খুলতেই কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন গ্রাহকদের হাজার টাকার বেশি দেওয়া হবে না। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের এমন নির্দেশিকা শোনার পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ। ব্যাঙ্কের কর্মীদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। কালিয়াচক-মোথাবাড়ি রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় গ্রাহকেরা। দু’ঘণ্টা ধরে রাজ্য সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে থাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। অবরোধ তুলতে পুলিশ গেলেও বিক্ষোভ দেখায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা। পরে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ দু’হাজার করে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেন তাঁরা। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের দাবি, টাকার জোগান কম থাকায় এমন সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
বারবার লিঙ্ক ফেল
এমনিতে এটিএমে টাকা নেই। তারপরে লিঙ্কও ফেল করছে বারবার। গাজোলের পাণ্ডুয়া থেকে এসেছিলেন ইসমাইল শেখ জেলাশাসকের দফতরের পাশে থাকা এটিএমটিতে টাকা তোলার জন্য সকাল সাড়ে দশটায় লাইনে দাঁড়ান। সে সময় তা খোলা ছিল না। খোলার আশায় অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এটিএমটি খোলার এক ঘন্টার মধ্যেই একবার লিঙ্ক চলে যায়। আসে। আবার বেলা একটা নাগাদ ফের লিঙ্ক চলে যায়। বহু মানুষকে ঠায় আরও আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার পর ফের লিঙ্ক এসেছে। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ‘‘একেই সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। তার পর যদি এভাবে লিঙ্ক ফেল হয়। তবে আমরা যাব কোথায়।’’ মালদহের লিড ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ শর্মা বলেন, ‘‘এটা নেটওয়ার্কের ব্যাপার।’’
পুরো দিনটাই মাটি
কোচবিহারের গোলবাগান এলাকার বাসিন্দা উদয়ন রায় বেসরকারি সংস্থায় কাজের সূত্রে হায়দরাবাদে থাকেন। ১ ডিসেম্বর ফেরার তারিখ। ট্রেনের টিকিটও কাটা হয়েছে। কিন্তু হাতে টাকা নেই। তাই ভোর পৌনে ছ’টায় এটিএমের লাইনে দাঁড়ান। ঘন্টা খানেকের মধ্যে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। না করেই বা উপায় কি! খালি পকেটে এত দূর ট্রেনের যাত্রা কি করে সম্ভব। বাবুরহাটের বাসিন্দা ধনঞ্জয় দেবনাথ সকাল ৬টায় লাইনে দাঁড়ান। বেলা দশটাতেও টাকা পাননি। টাকা না থাকায় সমস্যা হয়েছে। কামতাপুর পিপলস পার্টির নেতা নুবাস বর্মনের ছেলে পড়াশোনার সূত্রে বারাসতে থাকেন। ফি মাসের শুরুতে টাকা ওকে পাঠাতে হয়। তুফানগঞ্জের কোন এটিএমে টাকা নেই। ব্যাঙ্কেও সমস্যা হচ্ছে। তাই কয়েকদিন ধরেই কোচবিহারের সাগরদিঘি পাড়ের এটিএমে লাইন দিচ্ছেন। দু’হাজার করে পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘তাতে অবশ্য পুরো দিনটাই মাটি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্পও যে নেই।”