নিকাশির এমনই হাল শহরের নতুনপাড়ায়। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
আশির দশকে এসে টনক নড়ল পুরসভার। কারন তখন পান্ডাপাড়া মহামায়াপাড়া সমেত শহরের বেশিরভাগ অংশ বৃষ্টি হলেই জলের তলায় চলে যাচ্ছে। আশির দশকে বামফ্রন্ট পরিচালিত পুরসভার পক্ষ থেকে শহরে নিকাশি নালা গঠনের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়। সেই প্ল্যান অনুমোদিত হয়নি। নব্বইয়ের দশকে আবার একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়। সেই প্ল্যানও অনুমোদিত হয়নি। এর পর ২০০২ সালে আরেকটি মাস্টার প্ল্যান পাঠানো হলে সেটিও অনুমোদিত হয়নি।
জলপাইগুড়ি শহরে নিকাশি নালার মোট দৈর্ঘ্য ১৩০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ নিকাশি নালা সংস্কারের জন্য মাঝে মাঝে টাকা এসেছে। সেই টাকা দিয়ে শহরের কিছু কিছু এলাকায় নিকাশি নালাগুলিকে অপরিকল্পিত ভাবে পাকা করা হয়। সেই পাকা করার কাজ বাম পরিচালিত পুরবোর্ড থেকে বর্তমানের তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড করে চলেছে। তাতে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শহরের জমা জল বহন করে নদীতে নিয়ে যাওয়ার কথা তা সম্পূর্ণ হয়নি। যে মূল নালাগুলির কাজ ছিল নদীতে জল বহন করে নিয়ে যাওয়া তারাও অকেজো হয়ে পড়ল।
জলপপাইগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন ভাইসচেয়ারম্যান এবং বর্তমান কাউন্সিলার পিনাকী সেনগুপ্ত বলেন, “পুরসভার পক্ষ থেকে পর পর চারবার বিভিন্ন সময় জলপাইগুড়ির নিকাশি ব্যবস্থা সুপরিকল্পিতভাবে গঠন করার জন্য মাস্টার প্ল্যান পাঠানো হয়েছিল। একটাও অনুমোদিত হয়নি। বিক্ষিপ্তভাবে নিকাশি নালা সংস্কারের জন্য মাঝে মাঝে টাকা এসেছে। সেই টাকা দিয়ে নিকাশি নালাগুলিকে যতটা সম্ভব সংস্কার করা হয়েছে। কাঁচা নালার জায়গায় কিছু কিছু অংশে পাকা নালা হয়েছে। আর কিছু হয়নি।”
জলপাইগুড়ি পুরসভার পক্ষ থেকে জলপাইগুড়ি শহর এবং আসেপাশের এলাকা নিয়ে আবারও একটি সুসংহত নিকাশি নালা প্রকল্পের পরিকল্পনা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। মোট খরচ ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৭ লক্ষ ৯০ হাজার ৪১৪ টাকা। পরিকল্পনাটি রাজ্য সরকারের মারফত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হবে। পরিকল্পনাটি তৈরি করতেই জলপাইগুড়ি পুরসভার খরচ হয়েছে ১২ লক্ষ টাকা।
পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “এ মাসের (জুলাই) কলকাতায় পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের পক্ষ থেকে সভা ডাকা হয়েছে। আমি আশাবাদী, রাজ্য সরকার উদ্যোগে নিচ্ছেন। এই প্রকল্প রূপায়ণে সমস্যা হবে না।” চেয়ারম্যান যাই বলুন না কেন, জানা গিয়েছে এই প্রকল্পটির জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জওহরলাল নেহেরু আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্প থেকে টাকা মঞ্জুর না করলে এই প্রকল্প রূপায়ণ সম্ভব হবে না।
এই উপেক্ষা আর বঞ্চনা আজ নতুন নয়। যে তিস্তা নদী শহরের প্রধান নিকাশি হলেও প্রতি বছর একসময় জলপাইগুড়ি শহরে তার তীরবর্তী এলাকা ভাসিয়ে নিত, তার হাত থেকে শহরকে বাঁচানোর জন্য একটি নিচু মাপের বাঁধ দিয়ে কাজ সারা হয়েছিল। পাহাড় থেকে নেমে আসা এত বড় একটা নদীর হাত থেকে বনাঞ্চল এবং জলপাইগুড়ি শহরকে রক্ষা করার জন্য কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। যার ফলে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসের চার তারিখে ঘটেছিল মহাপ্রলয়। সংবাদপত্রে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসের ৫ তারিখে প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল, “বাঁধভাঙা জলের তোড়ে জলপাইগুড়ি শহরে প্রলয়।”
সে দিন তিস্তা নদীর বাঁধভাঙা জলের তোড়ে প্রাণ হারিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষএবং গবাদি পশু। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাহাড়পুর এলাকা। তারপর জলপাইগুড়ি শহরের রায়কতপাড়া, সেনপাড়া এবং টোপামারী এলাকা।
সেদিনের কথা ভেবে এই ৭২ বছর বয়সেও কেঁদে ফেললেন সিপিআই-এর প্রাক্তন জেলা সম্পাদক পবিত্র ভট্টাচার্য। পবিত্রবাবু সেদিন তাঁর মা দুলালি ভট্টাচার্য হারিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে পবিত্রবাবু জানান যে, ১ তারিখ থেকেই জলপাইগুড়ি শহরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। তিন দিন ধরে সমানে বৃষ্টি চলছিল। ৩ অক্টোবর তাঁদের যৌথ পরিবারে রাতের খাওয়া খেয়ে বাড়ির সকলে শুয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মা এবং দু’ভাই এক ঘরে ছিলেন। রাত দুটো নাগাদ প্রবল চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে পড়েন। বাড়ির মধ্যে তখন হাঁটু সমান জল। বুঝতে পারেন তিস্তার জল ঢুকেছে। জল এত দ্রুত বাড়ছিল যে মুহূর্তের মধ্যে কোমর ছাড়িয়ে যায়।
তারা সকলে সামনে একটি পাকা দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বার হয়ে পড়েন। পবিত্রবাবুর মা ভাল সাঁতার জানতেন। তিনি একে একে বাড়ির সবাইকে সেই পাকা বাড়িটিতে নিয়ে যান। তাঁর ছোট ছেলে সাঁতার জানতো না। তাকে পিঠে নিয়ে সাঁতার কেটে সেই বাড়িটির কাছে নিয়ে যান। ততক্ষণে জল দুমানুষ ছাড়িয়ে গেছে। সকলের প্রাণ বাঁচানোর পর তিনি একটি লিচু গাছ ধরেছিলেন। সেই সময় একটি দোকানঘর এসে তাঁকে চাপা দিয়ে দেয়। পাঁচ তারিখ সকালে তাঁর প্রানহীন দেহ খুঁজে পাওয়া যায়।
রায়কতপাড়ার আর এক বাসিন্দা বুলগান বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন মা এবং ছোট বোনকে হারিয়েছিলেন। শুধু পবিত্রবাবু ও বুলগান বাবুই না, শহরে এরকম শোকার্ত পরিবার আরও অনেক আছে। তাঁরা কেউই চান না আবারও একটি মহাপ্রলয় আসুক। পবিত্রবাবু, বুলগানবাবু এবং শহরের বাসিন্দাদের বক্তব্য, “আমরা একবার মহাপ্রলয় দেখেছি। শহরের জলবদ্ধতা আবার একটা মহাপ্রলয় ডেকে আনুক আমরা চাইনা। বিজ্ঞানসন্মতভাবে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক।”