কান্তেশ্বরের দিঘি
সুন্দরী জলপাইগুড়ি শহরের স্মৃতি রোমন্থনে মনে পড়ে যায় জোনাকির ঝিকিমিকি, ঝিঁঝির ঝিঁঝি এবং ব্যাঙের ডাক। যা ছিল শহরের সন্ধ্যার পরিচিত শব্দ। প্রচুর পুকুর ডোবা, দিঘি এবং নর্দমা সবই থাকতো। অর্থাৎ ওই জলাভূমিই ছিল জীববৈচিত্র্যের একটা আদর্শস্থল।
কিন্তু আজ সেই জোনাকির জায়গা নিয়েছে ত্রিফলা আলো, ঝিঁঝির স্থান নিয়েছে বিভিন্ন যানবাহনের শব্দ এবং সেই সোনাব্যাঙ কোলাব্যাঙের আশ্রয়স্থলে স্থান পেয়েছে বড় বড় অট্টালিকা। ফলে এখন শহরে হাতে গুণে বলা যায় কয়েকটি ডোবা এবং পুকুর আছে। যার ফলে জলপাইগুড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ভীষণ ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ জলাভূমি পরিবেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ বিজ্ঞানীরা একমত যে, মানুষের অস্তিত্বের জন্য জলাভূমির অস্তিত্ব একান্ত ভাবে জরুরি। এটি পরিবেশের ‘ফিল্টার’ রূপে কাজ করে। সুতরাং এখন কিন্তু আমাদের জলাভূমি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বর্তমানে যে ক’টি পুকুর এবং জলাশয় রয়েছে এখন তাদের সংরক্ষণ বিশেষ প্রয়োজন। শহরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যে কারণে এই পুকুর এবং দিঘির সংস্কার করে জলধারণের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমানে জলপাইগুড়ির সব নালাগুলি কংক্রিট নির্মিত। ফলে বৃষ্টির জল নালাপথে নদীতে গিয়ে মেশে। জলাভূমির অভাবে সেই জল ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছেনা। ফলে জলস্তর ক্রমশ কমছে এবং তাতেই পানীয় জলসঙ্কট দেখা দেবে এবং আমরাও আর্সেনিকের কবলে পড়তে পারি।
জলসঙ্কট মোকাবিলায় এই ‘জল ধরো জল ভরো’ নীতি এই জলাভূমিগুলোতেই প্রযোজ্য, যা আমাদের শহরে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই ভাবে জলাভূমি লোপ পেতে থাকলে শহরে বিভিন্ন রোগ দানা বেঁধে বসবে। যেমন ম্যালেরিয়া। কারণ বর্তমানে শহরে ব্যাঙের খুবই অভাব যার প্রধান খাদ্য মশা।
বৃষ্টির বা বন্যার অতিরিক্ত জল যেমন এই জলাভূমি ধারণ করে তেমনই অনেক পলি এবং আবর্জনা থিতিয়ে পড়ে ফাইটো প্ল্যাংটন (জলজ উদ্ভিদ যা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়) এবং জু প্ল্যাংটন (জলজ প্রাণী যা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়) জন্মানোর উপযোগী হয় এবং পরবর্তীতে একটি জলীয় বাস্তুতন্ত্রের রূপ নেয়। যেখানে কচুরিপানা এবং অন্য শ্যাওলা ভারী ধাতব সীসাকে শোধন করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে এবং উদ্ভিদ প্রজাতির পরিবেশে অক্সিজেন যোগায়।
শহরে যে সামজিক বনসৃজনের প্রয়োজন, তা জলাভূমিকে কেন্দ্র করেই সম্ভব। বর্তমানে আমাদের শহরে তাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শহরে জনবসতির চাপে নানা রকম ভাবে জমি ব্যবহারের ফলে আজ এই জলাভূমিগুলি অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
আমাদের আজ সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। এই জলাভূমিগুলিকে বাঁচাবার জন্য সরকারি প্রচেষ্টায় সংলগ্ন মানুষ তার পরিবেশের অঙ্গ জলাভূমিকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য যাতে সুন্দরভাবে রেখে যেতে পারে সেই অঙ্গীকার করতে হবে।
কৃষ্ণা দে সরকার, জলপাইগুড়ি
মসজিদের পুকুরের হাল এখন এমনই।
জলাভূমি রক্ষা করতে গেলে দরকার সমীক্ষা
সারা পৃথিবীর জলাভূমিগুলি আজ তীব্র সঙ্কটের মুখে। খুব স্বাভাবিক ভাবে জলপাইগুড়ি শহর এবং শহরতলি তার ব্যতিক্রম নয়। শহরের প্রায় ১৪-১৫টি চিহ্নিত জলাভূমিগুলির (পুকুর বা দিঘি) সিংহভাগই মৃতপ্রায়। পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৮৭ (সংশোধিত ১৯৯৩) যার মধ্যে আইনি রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও এদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। বেঁচে থাকা জলাভূমিগুলি তাদের বাঁচার শেষ লড়াই লড়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের বাঁচানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি উদ্যোগে জলপাইগুড়ি সায়েন্স এ্যান্ড নেচার ক্লাবের মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও এই প্রবণতাকে আটকানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মৎস্য দফতরের সহযোগিতায় কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গেলেও ভূমি রাজস্ব দফতরের এক শ্রেণির দালালচক্র, কিছু সরকারি কর্মচারী এবং কিছু রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে সমস্যাটি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। বারংবার জানানো সত্ত্বেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। উল্টে কোনও সচেতন নাগরিক এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসলেও অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের অসহযোগী মনোভাব তাদের প্রচেষ্টাকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।
জলাভূমির উপকারিতা বা প্রয়োজনীয়তা স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। মনে রাখা দরকার আমাদের জীবনের সঙ্গে এটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
জলাভূমিগুলি বাঁচাতে হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমস্ত জলাভূমিগুলির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা প্রয়োজন। প্রতিটি জলাভূমির উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লাগাতার স্থানীয় জনগণকে জানানো দরকার। আইনি রক্ষাকবচকে ব্যবহার করে প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। দলমত নির্বিশেষে জলাভূমিগুলির সুরক্ষার জন্য এক দিকে যেমন প্রশাসনের সৎ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, অপর পক্ষে, স্থানীয় জনগণকেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পুকুর বা দিঘিগুলির পাড় পারতপক্ষে কংক্রিট আকারে বাঁধানো যাবে না। পাড়গুলিতে সমাজভিত্তিক বনসৃজন করতে হবে।
পুকুর বা দিঘিগুলিকে নর্দমা, ভ্যাট এবং ডাস্টবিন বানানো যাবে না। পুরসভার স্থানীয় ওয়ার্ডগুলিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ‘অ্যাকশন গ্রুপ’ তৈরি করা দরকার যারা এলাকায় ঐ জলাশয়গুলির ওপর নজরদারি করবে। তারা জলাশয়গুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন জলজ প্রাণি এবং উদ্ভিদের চাষের কাজে লাগাতে পারবে।
বদ্ধ জলাশয়গুলিতে অবিলম্বে প্রতিমা নিরঞ্জন বন্ধ করা দরকার। মজা জলাশয়গুলিকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এর পূর্বাবস্থায় ফেরানোর প্রচেষ্টা করা দরকার। অন্যথায়, আমাদের ভোগবাদী মানসিকতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করার জন্য বাধ্য থাকবে।
গৌতম ঘোষ, জলপাইগুড়ি
ছবি: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।