আদালতে নথি সংশোধনের ভিড় মালদহে (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
মালদহের প্রত্যন্ত বামনগোলা ব্লকের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা নগেন্দ্রনাথ রায়। তবে দু’মুঠো ভাত জোগাতে কয়েক বছর আগে ছেলে-সহ তিনি বেঙ্গালুরুতে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানে বহুতলে মিস্ত্রির কাজ করেন দু’জনে। স্ত্রী পারুল গোবিন্দপুরের বাড়িতে একা থাকেন।
নগেন্দ্র জানান, তাঁর ও স্ত্রীয়ের ভোটার ও আধার কার্ডে তথ্যে ভুল সংশোধনে দিনসাতেক আগে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে এসেছেন। কেন এত তাড়াহুড়ো?
নগেন্দ্রর কথায়, ‘‘নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি আতঙ্কে কাজ ফেলে দিয়ে এফিডেভিট করে আধার ও ভোটার কার্ড সংশোধনের জন্য বাড়ি ফিরতেই হয়েছে।’’ তিনি জানান, কাজ সেরে ফিরে যাওয়ার পরে তাঁর ছেলেও আগামী সপ্তাহে একই কাজে মালদহে ফিরবেন।
শুধু নগেন্দ্র নয়, নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি আতঙ্কে কাজ ফেলে ভিন্ রাজ্য থেকে মালদহের বাড়িতে ফিরেছেন অনেকেই। তাঁদের বেশির ভাগই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সংশোধনের জন্য এফিডেভিট করাতে ভিড় জমাচ্ছেন মালদহ জেলা প্রশাসনিক ভবনের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে। কেউ যাচ্ছেন আধার কেন্দ্রগুলিতেও।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ১০ টাকার স্ট্যাম্পপেপারে এফিডেভিট করিয়ে ভোটার ও আধার কার্ড বা জমির পরচায় ভুল সংশোধন করছেন সকলে। আর তার জেরে গত বছরের তুলনায় এ বার ওই আদালতে এফিডেভিটের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দশ গুণ। শুধু তাঁরাই নন, জেলার অনেক বাসিন্দাই প্রতি দিন এফিডেভিট করাতে ভিড় জমাচ্ছেন সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। যা সামাল দিতে মহকুমাশাসক দফতরের কর্মীরা তুমুল ব্যস্ত।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর সেখানে আধার ও ভোটার কার্ডে ভুল সংশোধনে এফিডেভিট হয়েছিল মাত্র ৮টি। ওই বছরেরই ২৬ ডিসেম্বর সেই সংখ্যা ছিল ৬টি। চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল ৯টি এফিডেভিট করা হয়েছিল। কিন্তু এনআরসি-র কথা জানার পরে এ বছরের অগস্ট মাস থেকে ওই কোর্টে এফিডেভিটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নতুন নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পরে সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। সেই সংখ্যা এখন পৌঁছেছে ৫০-৬০টিতে। ১৮ ডিসেম্বর ৬০টি এফিডেভিট করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর হয়েছে ৫৫টি।
প্রশাসনের তরফে জানা গিয়েছে, ওই আদালতে সাধারণ ভাবে জমি সংক্রান্ত বিরোধের মতো বিষয়ে অভিযোগ দায়ের এবং তার নিষ্পত্তি করা হয়। সামান্য কয়েকটি এফিডেভিট-ও হয়। কিন্তু এখন কার্যত এফিডেভিট-এর কাজই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
সেখানকার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি আতঙ্কে এই কোর্টে এফিডেভিটের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে।’’ শুধু প্রশাসনিক কর্তারাই নন, একই কথা বলছেন বাসিন্দারাও। পাশাপাশি তাঁরা এফিডেভিট বা তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে নানা জটিলতার কথাও তুলে ধরেছেন।
নগেন্দ্র বলেন, ‘‘দু’দিন আগে এসে মুহুরিকে দিয়ে এফিডেভিট সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র ঠিক করে গিয়েছি। এ দিন ভোরে স্ত্রীকে নিয়ে বাস রওনা দিয়ে সকাল ১০টার মধ্যে জেলা প্রশাসনিক ভবনে এসেছি। দুপুর ২টোর পরে এফিডেভিটের কাগজ পেলাম।’’ ইংরেজবাজার ব্লকের মিলকির বাসিন্দা ওসমান শেখ বলেন, ‘‘ভোটার কার্ড করার সময় সমস্ত নথি জমা দিয়েছিলাম। সরকারি কয়েক জন কর্মীর ভুলে নাম ও ঠিকানা ভুল থেকে গিয়েছে। এত দিন তা খেয়াল করিনি। এখন বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে তা সংশোধনে এফিডেভিট করতে হচ্ছে।’’