না জেতালে বন্ধ উন্নয়ন, তৃণমূলের প্রচারে চড়ছে ক্ষোভ

রাজ্যে যে শাসক দল, তাদের হাতে পুরসভা না থাকলে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন মন্তব্য করে যেন পুরভোটের সুর বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরবঙ্গের পুরভোটের প্রাক্কালে সেই সুর আরও জোরাল করতে যেন প্রতিযোগিতা চলছে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের একাংশের মধ্যে!

Advertisement

অনির্বাণ রায়

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৪০
Share:

রাজ্যে যে শাসক দল, তাদের হাতে পুরসভা না থাকলে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন মন্তব্য করে যেন পুরভোটের সুর বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তরবঙ্গের পুরভোটের প্রাক্কালে সেই সুর আরও জোরাল করতে যেন প্রতিযোগিতা চলছে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের একাংশের মধ্যে!

Advertisement

গত মাসের শেষের দিকে শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘রাজ্যের সব পুরসভায় তৃণমূল জিতলে ভাল হয়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ছিল, ‘‘সরকার ও স্থানীয় বোর্ড এক না হলে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যায়।’’ তার পরে তৃণমূলের নেতা সরাসরি দলের প্রার্থীকে রাজ্য সরকারের প্রার্থী বলেও বাসিন্দাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, কোনও প্রার্থী দেওয়ালে নিজের নামের আগে ‘সরকারি প্রার্থী’ লিখে দিয়েছেন।

বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, তৃণমূল প্রচারে খোলাখুলি জানিয়েই দিচ্ছে, অন্য দলকে ভোট দিলে রাজ্য সরকার উন্নয়ন করবে না। রাজ্যের শাসক দলের প্রচারের এই ধরন নিয়েই আপত্তি তুলেছেন বিরোধী থেকে বিশিষ্টজনেরা। এই প্রচারকে সংবিধান বিরোধী বলে দাবি করে বিরোধীদের অভিযোগ, তৃণমূলের এই প্রচার স্বায়ত্তশাসনের কাঠামো ধ্বংস করবে।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া এই সুরেই কোচবিহারের জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষ প্রচারে দলের প্রার্থীদের সরকারি প্রার্থী বলে দাবি করেছিলেন। দলের প্রার্থীদের প্রশাসনিক সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার কথাও কর্মিসভায় ঘোষণা করেছিলেন রবিবাবু। তার জন্য তাঁকে নির্বাচন কমিশনের ‘শো কজে’র মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। শিলিগুড়ির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী দেওয়ালে নিজের নামের আগে ‘সরকার মনোনীত প্রার্থী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে পড়ে দেওয়াল লিখন মুছে দেন প্রার্থী জয়প্রকাশ চৌহ্বান। একই ভাবে, গত সোমবার কালনা এবং মেমারিতে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভায় জানিয়ে দিয়েছেন, দলের প্রার্থীদের আলাদা কোনও নাম নেই, সকলেরই নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধীদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নাম করেই ভোট চাওয়া হচ্ছে। সে কথা যে ঠিক তা বোঝা গিয়েছে, একই দিনে শিলিগুড়ির আশ্রম পাড়ায় এক পথসভায় তৃণমূলের শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও যখন সরাসরি বলেন, ‘‘যখন ভোট দিচ্ছেন, মনে করবেন মুখ্যমন্ত্রীকে ভোট দিচ্ছেন।’’ ‌

তৃণমূলের এই প্রচারকে ‘স্বৈরতন্ত্র’ কায়েমের চেষ্টা বলে অভিযোগ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার দাবি, সরকারি ক্ষমতা দেখিয়ে তৃণমূল রাজ্যে একদলীয় শাসন তৈরি করতে চাইছে। অভিযোগ তুলেছে বামেরাও। বিরোধী দলগুলির মতো সরাসরি রাজনৈতিক মন্তব্য করতে না চাইলেও, তৃণমূলের প্রচার ‘লাইন’ যে গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খায় না, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্টদের একাংশও।

শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুলের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক তথা লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিধানসভা থেকে পুরসভা, একদলীয় সাসন কায়েম করার পক্ষে মত দিতে পারছি না। কারণ, এটা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। মনে রাখতে হবে, ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবও বলে গিয়েছেন, যত মত, তত পথ।’’

উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা উমেশ শর্মা বলেন, ‘‘রাজনীতির কোনও বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে গণতন্ত্রে বহুত্ববাদ প্রকাশিত হবে এটাই কাঙ্ক্ষিত। নানা মত-আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকমের কর্মধারা তৈরি হবে, তাতেই এলাকার সুংসহত উন্নয়ন হবে। বহুত্ববাদ বিঘ্নিত হলে গণতন্ত্রেরও ক্ষতি।’’ উমেশবাবুর মতে, ‘‘আমাদের সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্র আঘাত পেলে, তার প্রভাব উন্নয়নে পড়বে।’’

তৃণমূলের অবশ্য পাল্টা দাবি, বিরোধী দলের হাতে থাকা বিভিন্ন পুরবোর্ডের উন্নয়নের বরাদ্দ আটকে রাখত আগের রাজ্য সরকার। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর গৌতম দেবের অভিযোগ, ২০০৯ সালে বামেদের হাতছাড়া হওয়ার পরে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকারের অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল শিলিগুড়ি পুরবোর্ডকে। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় বোর্ডে সমমনস্ক দল থাকলে, উন্নয়নে সুবিধে হয়। এটাই সত্যি কথা। বিরোধীরা ভুল ব্যাখ্যা করছে।’’

দীর্ঘ দু’দশক ধরে রাজ্যের পুরমন্ত্রী ছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। এবার শিলিগুড়ি পুরভোটে বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী তিনিই। অশোকবাবু বলেন, ‘‘বিরোধী পুরসভাগুলিও যাতে প্রয়োজনীয় অর্থ পায়, আমি সব সময়েই সে দিকে নজর রেখেছি।’’ বাম আমলে বেশ কিছু পুরবোর্ড বরাবরই বিরোধীদের দখলে থাকার কথা মনে করিয়ে, অশোকবাবুর প্রশ্ন, ‘‘উন্নয়ন না হলে সেই এলাকার বাসিন্দারা কেন বিরোধীদের ভোট দিতেন?’’

বিরোধীরা অভিযোগ করলেও, বিশিষ্টজনেদের সমালোচনার মুখে পড়লেও প্রচারের ‘লাইন’ বদলাচ্ছে না তৃণমূল। এ দিন মঙ্গলবারেও একই সুর শোনা গিয়েছে গৌতমবাবুর মুখে। শিলিগুড়ির চার্চরোডে ব্যবসায়ী সংগঠনের এক সভায় মন্ত্রী গৌতমবাবু দলের প্রার্থীর সমর্থনে ভোট চেয়ে বলেছেন, ‘‘আপনারা আমাদের দলের প্রার্থীকে জিতিয়ে দিন, আমি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে সব কাজে সাহায্য করব।’’

এক সময়ে বামেদের বিরুদ্ধে সরকারে দলতন্ত্র কায়েম করার যে অভিযোগ শোনা যেত তৃণমূল নেতাদের মুখে। এবারের পুরভোটের মুখে সেই অভিযোগেই বিদ্ধ শাসকদল তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement