মুস্তাক আহমেদের ছেলে ইশতিয়াক। —নিজস্ব চিত্র।
কেউ কথা রাখেনি।
সাদা কফনে ঢাকা বাবার মরদেহের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বছর সতেরোর ইশতিয়াকের কাঁধে হাত রেখে অনেকেই বলেছিলেন, ‘‘এক দম ঘাবড়াবে না, আমরা আছি তো।’’ পাশ থেকে কখন যে নিঃশব্দে সরে গিয়েছিলেন তাঁরা, ইশতিয়াক বুঝতেও পারেননি। এই দশ বছরে, মধ্য কলকাতার তস্য গলি ক্যান্টোফার লেনের ভাড়া বাড়ির দরজায় সেই খাঁকি উর্দির কতার্দের এক জনও কি কড়া নেড়েছেন? মনে পরছে না ইশতিয়াকের। তিনি কি তাঁদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন? বিষণ্ণ একটা হাসি খেলে যায় ইশতিয়াকের মুখে। বলছেন, ‘‘যাঁরা সরকারি চাকরি হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে বার চারেক ঘোরার পরেই বুঝে গিয়েছিলাম পরিণতি কী ঘটতে চলেছে।’’ জাতীয় পতাকায় মোড়া বাবার কফিন, বিউগল, গান-স্যালুট দেখে একটা বিশ্বাস যে জন্মেছিল, মেনে নিচ্ছেন ইশতিয়াক। তবে, তা ভেঙে পড়তে সময় লাগেনি। তাঁর বাবা মুস্তাক আহমেদ (৪৫) ছিলেন কালিম্পং-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। ২০০৫ সালে পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে জ্বলছিল উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই আন্দোলন সামাল দিতে পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলেন মুস্তাক।
২০ সেপ্টেম্বর, সকালে প্রায় রণক্ষেত্রের চেহারা নেওয়া কোচবিহারের চকচকা এলাকায় আন্দোলকারীদের সরিয়ে দিতে গিয়ে উন্মত্ত জনতার ঘেরাটোপে পড়ে গিয়েছিলেন মুস্তাক। ক্ষিপ্ত জনতার বেধড়ক পিটুনির মাঝে নিজের সার্ভিস রিভলভারটাও বের করার সুযোগ পাননি ওই পুলিশ অফিসার। রাতে শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে মারা যান মুস্তাক। কার্শিয়াঙের স্কুলে তখন দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ইশতিয়াক। উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করে তড়িঘড়ি মাকে নিয়ে পাহাড় থেকে কলকাতায় মামাবাড়িতে নেমে এসেছিল সে। তার কয়েক মাসের মধ্যেই ঠিকানা বদলে যায় ক্যান্টোফার লেনের এই ভাড়া বাড়ি। নিজের চেষ্টায় বি-কম পাস করে কড়া নেড়েছিলেন সরকারের দরজায়। ওই পুলিশ কতার্দের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা যে বলেছিলেন চাকরি হয়ে যাবে, আমি স্নাতক হয়ে গেছি।’’ দু’বার সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত চাকরিটা আর হয়নি। কেন?
ইশতিয়াক বলছেন, ‘‘বাবার বন্ধু এক অফিসার বলেছিলেন, ‘তোমার বাবার মৃত্যুর সময়ে বয়সটা আর মাস ছয়েক বেশি হলেই কোনও সমস্যা হত না।’’ তিনি শুনিয়েছিলেন নিয়মের কথা, কমর্রত বাবা-মা’র মৃত্যুর ছ’মাসের মধ্যে সাবালক হলেই চাকরি বাঁধা। মাথা নিচু করে ইশতিয়াক পাল্টা বলেছিলেন, ‘‘মারা যাওয়ার আগে, বাবা বোধহয় নিয়মটা জানতেন না।’’ তারপর এম-কম পাস করেছেন ইশতিয়াক। নিজের চেষ্টার একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিও জুটিয়েছেন মাস কযেক আগে।
সেই সময়ে মুস্তাক-হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, সঠিক তথ্য-প্রমাণের অভাবে শুক্রবার তাঁরা সবাই ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন কোচবিহার আদালত থেকে। শুনে রাগ হচ্ছে?
ইশতিয়াকের জবাব, ‘‘না। বলতে পারেন লজ্জা হচ্ছে। বাবার মৃত্যুতে শুধু আমাদের পরিবারের ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি তো গোটা পুলিশ বিভাগের। রাজ্য সরকারেরও। এক জন সহকর্মীকে পিটিয়ে মারার হলেও তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে পারে না পুলিশ?’’ একটু চুপ করে থেকে বলছেন, ‘‘এর পরেও সাধারণ মানুষ পুলিশের উপরে বিশ্বাস রাখবে?’’
দশটা বছরের চড়াই-উৎরাই শক্ত করে দিয়েছে ইশতিয়াককে। সকাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়েন বাইক নিয়ে। সল্টলেকের অফিস থেকে ফিরতে কোনওদিন ৬টা, কোনও দিন রাত ১০টা গড়িয়ে যায়। সারাটা দিন ছোট্ট ফ্ল্যাটে ছেলের অপেক্ষায় একা বসে থাকেন ইশতিয়াকের মা, মেহের নিগর। ছেলে বলছেন, ‘‘এখনও রাতের অন্ধকারে পাশের ঘর থেকে মায়ের ফুঁপিয়ে কাঁদার আওয়াজ পাই জানেন।’’ ২০ সেপ্টেম্বরের সেই সকালে মারা যান কোচবিহার জেলা পুলিশের দুই কনস্টেলও, গৌরচন্দ্র ধর এবং যোগেশচন্দ্র সরকার। কোচবিহারের রবীন্দ্রনগর এলাকার গৌরবাবুর পরিবার এ দিনের রায়ের কথা জানতেনই না। তাঁর স্ত্রী-পুত্র এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি। তবে গৌরবাবুর ভাই নিতাইবাবুর ভরসা রয়েছে পুলিশের উপরে। বলছেন, ‘‘জেলা পুলিশ বিভাগ আমাদের পাশে ছিল। তাদের ওপর আস্থা আছে।’’