ভগ্নপ্রায় ইউরোপিয়ান ক্লাব।
নতুন পুরবোর্ডের কাছে আগাম দশটি দাবি
পুরসভার মর্যাদা জলপাইগুড়ি পেয়েছিল ১৮৮৫ সালে। পেরিয়ে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। নিকাশি ব্যবস্থা থেকে যানজট, পরিবেশ থেকে স্বাস্থ্য—আজও অজস্র সমস্যায় জর্জরিত এই শহর। এই স্বল্প পরিসরে সেই সমস্যাগুলির দিকে আমরা ফিরে তাকাব একবার।
জলপাইগুড়ির সৌন্দর্যরেখা শুধু আয়ত তিস্তা নয়, কবিতার মতো সুন্দর করলাও। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে এসে যে নদী শহরের বুক চিরে তিস্তায় মিশেছে। ক’টা শহরে এমন টলটলে জলের স্বচ্ছতোয়া নদী আছে! ঠিক যেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে।’’ অথচ নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, থার্মোকলের মতো উপচে পড়া আবর্জনায় ভারাক্রান্ত করলা। দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর সময়ে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় এই নদীতে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ে দূষণ। আগের পুরবোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড যখন গড়া হয়, তখন বলা হয়েছিল করলার দ্রুত সংস্কার হবে। কিন্তু দু’বছরেও পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়েনি।
জলপাইগুড়িতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে দু’হাজারের কিছু বেশি লোক বাস করেন। জনসংখ্যা যত বাড়ছে, যানবাহন তত বাড়ছে, বাড়ছে যানজট। তিন ও চার নম্বর রেল গুমটিতে উড়ালপুলের দাবি উঠেছে অনেকবার, কিন্তু শুকনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যানি। ফলে নিত্য যানজটে হাঁসফাস করছে এই জেলা শহর। যেখানে সেখানে লরি দাঁড় করে পণ্য ওঠানো নামানো চলছে। যেখানে সেখানে বাস বা অটো রিকশা যাত্রী তুলছে। হালে সেই সমস্যায় যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত টোটো। সেই গাড়িগুলির জন্য আলাদা কোনও স্ট্যান্ডের ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছে।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য একটি ক্লাব তৈরি করেছিল ইংরেজরা। জলপাইগুড়ি ক্লাব নাম দিলেও এই ক্লাব পরিচিত ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব’ নামে। দোতলায় পাঁচটি থাকার ঘর, একতলায় একটি পানশালা, দু’টি হলঘর, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর এবং একটি লাইব্রেরি ছিল। ক্লাবের নিজস্ব মাঠে ছিল চার-চারটি টেনিস কোর্ট। সেই ঐতিহ্যপূর্ণ ক্লাবের আজ জরাজীর্ণ দশা।
এদিকে শহরে ছেয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল। বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজ। ফলে মাঠমুখো ছেলেদের সংখ্যা কমছে। পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক দূষণ। শহর জুড়ে মাদকের আমদানি উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নেশায় আসক্ত করে তুলেছে। তিস্তা ও করলা নদীর বাঁধের স্পারে ‘এদের’ দৌরাত্ম্যে মানুষ শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন। শান্তিপ্রিয় এই শহরে ক্রমাগত বাড়ছে অসামাজিক কর্মকাণ্ড।
স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক চাহিদা। জেলা হাসপাতালের শয্যা অপ্রতুল, দক্ষ চিকিৎসকের আকাল। ডায়ালিসিস, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি যন্ত্র বসালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এদিকে নার্সিংহোমে চিকিৎসা করাতে গেলে মধ্যবিত্তের ঘটিবাটি বিক্রি করার দশা। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার আরও কারণ রয়েছে। ওষুধের দোকান রাতে বন্ধ হয়ে যায়। একটু বেশি রাতে আপৎকালীন ওষুধের প্রয়োজন যাঁদের হয়েছে তাঁরাই শুধু জানেন কতটা অসহায় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
আগামী মাসেই জলপাইগুড়ি শহরবাসী পেতে চলেছে নতুন এক পুরবোর্ড। সেই পুরবোর্ডের চেয়ারম্যান বা চেয়ারপার্সনের কাছে যে দাবিগুলি থাকবে তা এক এক করে পেশ করছি।
এক, যাতে তিনি শহরের ফুটপাত দখল করে তৈরি হওয়া সব রকম নির্মাণ ভেঙে রাস্তা সম্প্রসারণ করার পদক্ষেপ করে। দুই, শহরের তিন নম্বর গুমটি থেকে মোহিতনগর গোলগুমটি পর্যন্ত রেল লাইনের পাশ দিয়ে সমান্তরাল রাস্তা তৈরিতে উদ্যোগী হন, যাতে রেলগুমটি বন্ধ থাকলেও শহরের বাসিন্দারা এই রাস্তা দিয়ে সহজেই শিলিগুড়ি যাতায়াত করতে পারেন। তিন, তিনি যেন শহরের পুরোনো স্থাপত্য এবং স্মারক রক্ষার ব্যবস্থা করেন। চার, শহরের যে খেলার মাঠগুলি আছে তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পাঁচ, পুরসভার পুরোনো বাজারগুলি সংস্কার করে ঘিঞ্জি পরিবেশের অবলুপ্তি ঘটান। ছয়, করলা নদীর পাড়ে ফুলগাছ দিয়ে সাজিয়ে বেশ কিছু বেঞ্চ বসিয়ে তার সৌন্দর্যায়ন করেন এবং নৌকাবিহারের ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে পুরসভার স্বল্প হলেও একটা আয়ের সংস্থান হতে পারে। সাত, শহরের বস্তি এলাকাতে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে সেখানে এক জন করে চিকিৎসক বসিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আট, শহরের বিভিন্ন এলাকায় নেশার কারবার রুখতে পুলিশকে দিয়ে নিয়মিত অভিযান চালান। নয়, শহরের কয়েকটি স্বল্পমূল্যের ওষুধ বিক্রি কেন্দ্র, এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। শহরে অন্তত পাঁচটি ওষুধের দোকান যাতে সারা রাত খোলা থাকে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য যেন তিনি পদক্ষেপ করেন। দশ, পুরসভার একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে উদ্যোগী হন, যাতে পুরসভার বাসিন্দারা নিজেদের মতামত বা অভিযোগ জানাতে পারেন।
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। জলপাইগুড়ি।