নদী মরছে, নামে কিন্তু ফি-বছর মোচ্ছব

বাংলাদেশকে আমরা নদীমাতৃক দেশ বলে থাকি। অথচ নদী উত্তরবঙ্গেও কম নেই। সেই নদীকে ঘিরে জমে উঠেছে অনেক গল্পও। দেবী চৌধুরাণীর বজরা যে ত্রিস্রোতা নদীতে চলতো, সেটাই আজকের তিস্তা। অথচ যত সময় যাচ্ছে, উত্তরের নদীগুলির যেন তত দিন ঘনিয়ে আসছে। বর্ষার সময় বাদ দিয়ে সেখানে গেলেই দেখা যাবে, বেশির ভাগ নদীখাত শুকিয়ে পড়ে রয়েছে। যেমন জয়ন্তী, তেমনই বালা বা বালাসন।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৭
Share:

এমনই হাল জলপাইগুড়ির করলা নদীর। — ফাইল চিত্র

বাংলাদেশকে আমরা নদীমাতৃক দেশ বলে থাকি। অথচ নদী উত্তরবঙ্গেও কম নেই। সেই নদীকে ঘিরে জমে উঠেছে অনেক গল্পও।

Advertisement

দেবী চৌধুরাণীর বজরা যে ত্রিস্রোতা নদীতে চলতো, সেটাই আজকের তিস্তা। অথচ যত সময় যাচ্ছে, উত্তরের নদীগুলির যেন তত দিন ঘনিয়ে আসছে। বর্ষার সময় বাদ দিয়ে সেখানে গেলেই দেখা যাবে, বেশির ভাগ নদীখাত শুকিয়ে পড়ে রয়েছে। যেমন জয়ন্তী, তেমনই বালা বা বালাসন। তার উপর দিয়ে গাড়ি চলেছে অক্লেশে। আর যেতে যেতেই দেখবেন, কোথাও নদী দখল হয়ে গিয়েছে। কোথাও ভয়াবহ গন্ধ নিয়ে নালার চেহারায় বয়ে চলেছে সেই নদী।

এই দীর্ঘ তালিকা থেকে এখানে তিনটি নদী বেছে নিলাম। দেখা যাক, তাদের অবস্থা কেমন।

Advertisement

সাহু: শিলিগুড়ির পাশে বয়ে চলা ছোট্ট নদী সাহু এখন একটা ডাস্টবিন ছাড়া কিছুই নয়। শালুগাড়ার কাছে নদীটির সামনে দাঁড়ালে দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠে। শিলিগুড়ি শহরের যাবতীয় নোংরা এমনকী মল পর্যন্ত নদীতে ফেলা হয়। ভোট যত বার আসে তত বার শোনা যায় সাহু নদীর সংস্কারের কথা। ওই শোনা পর্যন্তই থাকে।

ফাইবাড়ি হাট, জলেশ্বরী হাট, হাতিয়াডাঙা এলাকায় নদীর চর দখল করে বহু মানুষ বসবাস করছে। এই সব মানুষ নদীর বুকেই মলমূত্র ত্যাগ করছে। এমনকী বাড়ির সমস্ত নোংরা আবর্জনাও নদীর বুকেই নিক্ষেপ করছে। সাহু নদীর জল আর জল নেই। তা বিষে পরিণত হয়েছে।

নদীর জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যে পৌঁছে গেছে। নদীর জলে কোনও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার অবস্থা নেই। নদীর জলে লেড, জিঙ্কের মতো ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আবার এই জলকেই নদী পাড়ের মানুষ ব্যবহার করছে। এমনকী সেচের কাজেও লাগাচ্ছে। কারণ তাদের কাছে বিকল্প জলের কোনও উৎস নেই।

করলা: জলপাইগুড়ির টেমস নামে পরিচিত করলা এখন মৃতপ্রায়। যে নালাগুলির জলে এই নদী একসময় পুষ্ট হতো, তাদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জলের অভাবে তারা মারা গিয়েছে। নোংরা কালো জল বুকে নিয়ে করলা অবশ্য কোনও রকমে টিকে আছে। করলার সংস্কারের কথা অনেক বার ভাবা হয়েছে শুধুমাত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। অরণ্যের নিধন ও জমির অত্যধিক ব্যবহারে করলা নদীর জীবন বিপন্ন হতে বসেছে। করলার বুকে পলি জমার হার এতটাই বেশি যে, নাব্যতা বলে এই নদীর আর কিছু নেই। তিস্তার নদীবক্ষ জলপাইগুড়ি শহর থেকে জমির অবস্থান উঁচুতে হওয়ায় বর্ষার মরসুমে তিস্তার জলই করলাতে ঢোকে। সেচ দফতর অনেক চেষ্টা করেও বন্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি।

গুয়াহাটি আইআইটি-র ২০১৫ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, করলার জলে দ্রবীভূত রাসায়নিকের পরিমাণ ৩৮.২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে এবং জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ০.৪ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে। এ ছাড়াও নদীর জলে অম্লতার পরিমাণ ৯.৩৩। অর্থাৎ করলা নদীর জলে অ্যাসিড বা অম্লতার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। আগে এই নদীতে জিওল, বোয়াল, চিতল, ফলুই, পাবদা, ৯ রকমে প্রজাতির চিংড়ি, বাচা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যেত। কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে এই নদীকে মেরে দিয়েছে বলে অভিযোগ। জলে বিষ মেশানোরও অভিযোগ উঠেছে। ফলে কার্যত নদীয়ালি মাছেরা সব মারা যায়। এই রকমই ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালের ১৩ মে। সেই সময় এন্ডোসালফানের মতো নিষিদ্ধ কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল জলে।

জলপাইগুড়ি শহরের পানীয় জল সরবরাহ করলা নদীর ওপরে নির্ভরশীল। কাজেই কতটা বিশুদ্ধ জল সেই শহরের মানুষেরা পায়, সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আগে কিংস ঘাটের কাছে তিস্তায় মিশত করলা। বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিস্তা-করলার মাঝ বরাবর একটি স্পার নির্মাণ করে করলার মোহনাকে ৪.৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে মণ্ডলঘাটের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে কিছুটা বন্যা নিয়ন্ত্রণ হলেও শুখা মরসুমে ভয়ানক জল কষ্টের সম্মুখীন হয় জলপাইগুড়ির মানুষ। কারণ দ্রুত করলার জল তিস্তায় চলে যাওয়ায় জলপাইগুড়ির পার্শ্ববর্তী অংশে মাটির তলার জলস্তর হু হু করে অনেক গভীরে নেমে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য একসময় ভাবা হয়েছিল তিস্তা-মহানন্দা সংযোগকারী খালের জল কিছুটা করলায় আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনও কাজই এখনও হয়নি। প্রতি বছর জলপাইগুড়িতে ঘটা করে ‘করলা উৎসব’ পালিত হয়। কিন্তু মানুষের মনে নদী নিয়ে ভালবাসার জন্ম হয় না।

বালাসন নদী: পার্বত্য জলে পুষ্ট বালাসন নদী পানিঘাটা ছাড়িয়ে ডালকাঝোর বনের পূর্ব দিক দিয়ে সমতলে এসে পড়েছে। দার্জিলিং থেকে নেমে এসে এই নদীর ভূমি-ঢাল ৩০-৪০ ডিগ্রির মধ্যে। কাজেই এই সব নদীতে চকিত বন্যার প্রভাব খুব বেশি। বন্যার সময় এই নদী প্রচুর পরিমাণে নুড়ি-কাঁকড়-বালি বয়ে নিয়ে আসে। স্থানীয় নেতাদের মদতে খাপড়ির কাছে প্রচুর ‘কাসাড়ি’ গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট মাইনিংগুলিকে স্থানীয় মানুষ কাসাড়ি বলে। নদী থেকে যত্রতত্র পলি-কাঁকড়-বালি তুলছে কাসাড়িরা। ১২০ টাকা প্রতি টনে এরা সাধারণ শ্রমিকের কাছ থেকে পলি-কাঁকড়-বালি কেনে। কিন্তু বিক্রি করে প্রচুর মুনাফায়।

পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্র খনিজ আইন, ২০০২-এর পঞ্চম ধারা অনুযায়ী নদীবক্ষের দু’পাশে ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও প্রকার খনিজ নদী গর্ভ থেকে তোলা যায় না। কার্যত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শাসক দলের মদতে পুষ্ট কিছু মানুষের সহায়তায় বালাসন নদী থেকে অবৈধ ভাবে খনিজ তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে নদীপথের গতিশীল ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। বর্ষায় নদী ভাঙনের পরিমাণও প্রকট হচ্ছে। এ ছাড়া ভূমি ধসের পরিমাণও বেড়ে চলেছে।

বস্তুত, নদীগুলিকে এ ভাবে খুন করার ফলে নানা ভাবে প্রকৃতি এবং তার সঙ্গে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা সেটা এখনও বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন উপলব্ধি হলেও আর কিছু করার থাকবে না।

নদীর উপরে বসতি থেকে শুরু করে তার গতিপথ কৃত্রিম ভাবে ঘোরানোর ফলে কী হচ্ছে? প্রথমত, নদীর গতিশীল ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নদী শুকিয়ে গেলে মাটির তলার জলস্তর অনেক নীচে নেমে যায়। করলার বেলাতেই সেটা হচ্ছে। তৃতীয়ত, নষ্ট হয় জীব বৈচিত্র। সর্বোপরি, জল শুকিয়ে গেলে মরে যায় আশপাশের সবুজ। এবং সব কিছু মিলে বিশ্ব উষ্ণায়নকে বাড়িয়ে তোলে।

এই ভাবেই সাহু, করলা, বালাসন তো বটেই, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের আরও অনেক নদী। দখল করে নেওয়া এমন নদী-তালিকায় রয়েছে শ্রীমতী, কাহালৈ, সুস্মিতা, আত্রেয়ী, তুলাই, ব্রাহ্মণী, বকরন্দি, ভালোয়া, বালান, গুলমা ইত্যাদির নাম। এমনকী, তিস্তাও যথেষ্ট সঙ্কটে। এই সঙ্কটের হাত থেকে নদীগুলিকে বাঁচাতে অবিলম্বে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। বেআইনি দখলদারি তো হঠাতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে নদীগুলিতে আবার জল ফিরে আসে।

তবেই বাঁচবে নদী, বাঁচবে উত্তরবঙ্গ।

(লেখক নদী বিশেষজ্ঞ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement