ইংরেজবাজারে দাপিয়ে বেড়াল তৃণমূল

মালদহের ইংরেজবাজারে একতরফা কর্তৃত্ব বজায় রাখল তৃণমূল। অন্তত, ভোটের দিন বুথে-বুথে যে ছবি দেখা গিয়েছে, তা যেন তা-ই বলছে বলে মনে করছেন শাসক বিরোধী শিবিরের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের অনেকেই। বিরোধীদের মধ্যে ভোটের ময়দানে বামেদের দেখা গেলেও ময়দানে দেখা যায়নি বিজেপি এবং কংগ্রেসকে।

Advertisement

অভিজিৎ সাহা

মালদহ শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩৭
Share:

৪৯ নম্বর বুথে সপরিবারে মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

মালদহের ইংরেজবাজারে একতরফা কর্তৃত্ব বজায় রাখল তৃণমূল। অন্তত, ভোটের দিন বুথে-বুথে যে ছবি দেখা গিয়েছে, তা যেন তা-ই বলছে বলে মনে করছেন শাসক বিরোধী শিবিরের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের অনেকেই। বিরোধীদের মধ্যে ভোটের ময়দানে বামেদের দেখা গেলেও ময়দানে দেখা যায়নি বিজেপি এবং কংগ্রেসকে।

Advertisement

তবে পুরাতন মালদহে শাসক দলকে ঠেকাতে বিরোধীরা জোট বেঁধেই আসরে নেমেছিল বলে কংগ্রেসের একাংশের দাবি। ফলে শাসক দল ভোট লুঠ করতে পারেনি বলে দাবি বিরোধীদের। তবে ইংরেজবাজারে ভোট লুঠ হয়েছে বলে দাবি করলেন দক্ষিণ মালদহের সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)।

এদিন সকাল থেকেই কোতুয়ালি ভবনে বসে তিনি কর্মীদের অভিযোগের কথা শুনেছেন। পরে তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘সন্ত্রাস করে ভোট লুঠ করেছে তৃণমূল। বিভিন্ন বুথে আমাদের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের ভয় দেখানো হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন শুধু বসে বসে কৃষ্ণেন্দুর দাদাগিরি দেখল। তবে পুরাতন মালদহে ভোট ভালোই হয়েছে।’’

Advertisement

ডালুবাবুর মতো তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললেন বিজেপি-র জেলা সভাপতি শিবেন্দুশেখর রায়। তিনি বলেন, এদিন ইংরেজবাজারে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। অবাধে শাসক দলের নেতা কর্মীরা ছাপ্পা ভোট দিয়েছে পুলিশ প্রশাসনের সামনে। এমন ভোট এর আগে কখনও ইংরেজবাজারের মানুষ দেখেননি। ইংরেজবাজারে ভোট লুঠ করলেও পুরাতন মালদহ শাসক দল তেমন দাগ কাটতে পারেনি। রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু দাঁড়িয়ে থেকে সন্ত্রাস করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘কৃষ্ণেন্দুবাবু নিজের ওয়ার্ড ছাড়াও অন্য ওয়ার্ডে গিয়ে সন্ত্রাস করেছেন। মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দিয়েছেন। তাঁর সন্ত্রাসের জবাব মানুষই দেবেন।’’

যদিও বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা তাদের কটাক্ষ করেছেন মন্ত্রী তথা ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কৃষ্ণেন্দুবাবু। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস বেশ কিছু ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতেই পারেনি। মানুষ তাদের পাশে না থাকায় এজেন্ট খুঁজে পায়নি। বিরোধীরা তাদের অস্তিত্ব সঙ্কট বুঝে এমন মন্তব্য করছেন। আর মালদহে এমন শান্তিপূর্ণ ভোট এর আগে কখনও হয়নি।’’ তাঁর বরং অভিযোগ, ‘‘কংগ্রেস সমর্থকেরাই ২০ নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের কর্মীদের মারধর করেছে।’’

বিরোধীদের দাবি, ইংরেজবাজার পুরসভার ২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই একক ভাবে ভোট করিয়েছে তৃণমূল। ১ থেকে ২১ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত দাপট দেখালেন শাসক দলের নেতানেত্রীরা। শহর জুড়ে কার্যত চষে বেড়াল তৃণমূলের বহিরাগত বাইকবাহিনী। এদিন ২০ থেকে ২৫ জনের একটি বাইক বাহিনীকে তৃণমূলের ব্যাজ পড়ে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন তাঁরা মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবুর নির্দেশে ইংরেজবাজারের যদুপুর থেকে এসেছেন। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘোরার নির্দেশ রয়েছে তাদের উপে। সেই যুবক বলেন, ‘‘আমরা আধঘন্টা শহরে ঘুরেছি। বাইকবাহিনীর দাপট ছাড়াও বহু ওয়ার্ডে বিরোধীদের এজেন্ট ছিল না। এমনকি মন্ত্রীর ওয়ার্ডেও।’’

মন্ত্রীর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বুথগুলিতে শুধু তৃণমূলেরই এজেন্ট ছিল। এবং ওই ওয়ার্ডের ৪৯ এবং ৫০ নম্বর বুথে কোন পুলিশকর্মীও ছিল না। এদিন সকাল ৮টা নাগাদ মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু, স্ত্রী তথা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কাকলি চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ভোট দিতে আসেন। ৪৯ নম্বর বুথে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঢুকে পড়েন তিনি। এবং কী ভাবে ভোট দিতে হয় তা শেখান। এরপর কখনও নিজের ওয়ার্ড, কখনও বা স্ত্রীর ওয়ার্ডে বাইকে বসে চষে বেড়ালেন। সেই সঙ্গে বারবার ফোন করে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বিরোধীদের দাবি, এই পুরসভার ৮,৯, ৪,১২ নম্বর ওয়ার্ডে অবাধে চলে ছাপ্পা ভোট। দলের কর্মীরা খেয়াল খুশি মতো নির্বাচনী কক্ষে ঢুকছেন আর বেড়িয়েছেন। এই ওয়ার্ডগুলিতে বামেদের নির্বাচনী এজেন্টদের বসে থাকতে দেখা গেলেও কংগ্রেস এবং বিজেপির নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন না। কংগ্রেস ও বিজেপি-র দাবি, তাঁদের এজেন্টদের আগেই হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাই তাঁরা ভয়ে বুথে বসার সাহস পাননি।

অন্য দিকে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কার্নি মোড়ে বসে ছয়টি ওয়ার্ড দেখাশোনা করেন তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী দুলাল সরকার। তাঁর নিজস্ব ওয়ার্ড ছাড়া ২১, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেও দাপিয়ে বেড়ান তাঁর অনুগামীরা। এদিন দুপুর দেড়টা নাগাদ ২০ নম্বর ওয়ার্ডের গয়েশপুরের ১০০ নম্বর বুথে শাসক দলের সঙ্গে কংগ্রেসের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ শূন্যে দুই রাউন্ড গুলি চালায় বলে অভিযোগ। অভিযোগ, এদিন দুপুরে ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী নবীন দাস ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করছিলেন। সেই সময় তৃণমূলের কর্মীরা বাধা দিলে তাঁদের মারধর করা হয়। পল্লব গঙ্গোপাধ্যায় এবং কাজল কুন্ডু নামে দুই জন জখম হয়েছেন। তাঁরা মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। অপরদিকে নবীনবাবু দুলালবাবুর কর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘শাসক দলের কর্মীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করছেন। এবং আমাদের কর্মীদের হুমকি দিচ্ছে।’’ এই পুরসভা এলাকায় ২২ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া কংগ্রেসের তেমন অস্থিত্ব ছিল না। যদিও কংগ্রেসের দাবি সন্ত্রাস করে ভোট করেছে তৃণমূল।

মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তি পূর্ণ হয়েছে। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে গোলমাল হয়েছিল। তবে পুলিশ গুলি চালায়নি।’’

শহরের ১১ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া আর কোনও ওয়ার্ডেই বিজেপি কর্মীদের উৎসাহ দেখা যায়নি। ময়দানে বিজেপির নেতাদেরও দেখা যায়নি। তবে বামেরা ২৪, ২৫, ২৮ এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁদের অস্থিত্ব জানান দিয়েছেন। এই ওয়ার্ডগুলিতে বাম নেতা কর্মীরাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তবে ইংরেজবাজারে শাসক দল একতরফা ভোট করাতে পারলেও পুরাতন মালদেহ ব্যর্থ। এই পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডে বিরোধী দলগুলি এক জোট হয়েছিল। তারা একজোট হয়ে লড়ার ইঙ্গিত আগে থেকেও দিয়ে রেখেছিল। কারণ, পুরসভার ৬ এবং ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিরোধীরা কোনও প্রার্থী না দিয়ে নির্দলকে সমর্থন করেছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement