তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁকে ছাড়াতে তাঁর ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মীরা থানায় গোলমাল বাধালে হাতে মাইক তুলে নিলেন অভিযুক্ত কাউন্সিলর। এ ভাবেই অনুগামীদের নিরস্ত করলেন শুভজিৎ কুণ্ডু। — হিমাংশুরঞ্জন দেব
তৃণমূলের এক সমর্থককের গুলি ও অন্য জনকে মারধরের অভিযোগকে কেন্দ্র করে দলের কোচবিহার পুরসভায় দলেরই এক কাউন্সিলরকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ওই কাউন্সিলর শুভজিৎ কুণ্ডু কোচবিহারের প্রয়াত প্রাক্তন পুরপ্রধান বীরেন কুণ্ডুর ছেলে। এখন শহরের পুরপ্রধান শুভজিৎবাবুর মা রেবাদেবী। শুভজিৎবাবুকে আদালতে তোলা হলে বিচারক এক দিনের জন্য তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আজ বুধবার তাঁকে ফের কোচবিহার জেলা আদালতে তোলা হবে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার সুনীল যাদব বলেন, “গুলিতে একজন জখম হয়েছেন। অন্য জনকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্তদের মদত দেওয়ার অভিযোগে শুভজিৎবাবুকে ধরা হয়েছে।”
এই ঘটনায় কোচবিহারে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নালিশও উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, শুভজিৎবাবুর ঘনিষ্ঠদের উপরেই প্রথম হামলা হয়েছিল। তার পরে পাল্টা হামলায় স্থানীয় তৃণমূল নেতা অভিজিৎ দে ভৌমিকের ঘনিষ্ঠরা আহত হয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, অভিজিৎ শিবিরের বিরুদ্ধেও গুলি চালানোর অভিযোগ হয়েছে। এসপি বলেন, “ওই অভিযোগও দেখা হচ্ছে।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা কোচবিহারের জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘আমি যতদূর শুনেছি, যাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। শুভজিতের লোকজনের উপরেই প্রথম হামলা হয় বলেও শুনেছি।’’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে তাঁর মত, ‘‘আমি বিষয়টি নিয়ে বিষদে খবর নিয়ে দলনেত্রীকে সব জানাব।’’
সোমবার রাতে কোচবিহার শহরের এল দাস মোড় লাগোয়া এলাকা আক্রান্ত হন তৃণমূল কর্মী দীপেশ লামা ও অমিত দাস। দীপেশের পেটে গুলির আঘাত রয়েছে। অমিতকে লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করা হয়। কোচবিহারের একটি নার্সিংহোমে দু’জনেরই চিকিৎসা চলছে। জখমরা তৃণমূল নেতা অভিজিৎবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। হামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির, তাঁরা কোচবিহার পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর শুভজিৎ কুণ্ডুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ঘটনায় অভিযুক্তদের মদত দেওয়ার অভিযোগে এ দিন দুপুরে পুলিশ শুভজিৎবাবুকে গ্রেফতার করে। এ নিয়ে কোতোয়ালি থানার সামনে শুভজিৎ অনুগামীরা বিক্ষোভ দেখান। পরে তাঁকে কোচবিহার জেলা আদালতে তোলা হয়। সেখানেও প্রচুর ভিড় উপচে পড়ে।
অভিজিৎবাবু ওই ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চাননি। তৃণমূল সূত্রের খবর, কোচবিহার শহরে শুভজিৎবাবু ও অভিজিৎবাবুর শিবিরের গোলমাল নতুন ব্যাপার নয়। আগেও ওই দুই গোষ্ঠীর সমর্থকরা কলেজের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক বার গোলমালে জড়ান বলে অভিযোগ। পাশাপাশি শহরের কাদের গোষ্ঠীর প্রভাব থাকবে, তা নিয়েও চাপানউতোর ছিলই। সোমবার রাতে বাড়ি ফেরার পথে অভিজিৎ ঘনিষ্ঠদের ওপর হামলার অভিযোগকে কেন্দ্র করে তা নতুন মাত্রা নেয়। অভিজিৎবাবুর ঘনিষ্ঠ রাকেশ চৌধুরী বলেন, “দুষ্কৃতীরা আমাদের কর্মীদের ওপর হামলা করে। যারা হামলা করেছে তাদের তৃণমূলের মিছিল মিটিংয়েও দেখা যায়। পুলিশ তদন্তের ভিত্তিতে কাকে গ্রেফতার করবে তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।” জখম অমিত বলেন, “আচমকা আমাদের উপর হামলা হয়। তৃণমূলের কিছু লোক ওই ঘটনায় জড়িত।” শুভজিৎবাবু গোষ্ঠী কোন্দলের অভিযোগ উড়িয়ে দেন। সকালে তিনি বলেন, “সকালে ওই ঘটনার কথা শুনেছি। যে বা যারাই করুক ঠিক হয়নি। যদি আমার নাম এতে উঠে আসে, তবে তা খুব দুঃখজনক।”
তৃণমূল সূত্রেই জানা গিয়েছে, শুভজিৎবাবুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথবাবুর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এ দিন রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “কোচবিহারের আইন শৃঙ্খলা ভাল ছিল, ভাল আছে। একদল দুষ্কৃতী মাঝেমধ্যে কোচবিহারকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ পার পাবে না।”
অন্য দিকে বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে দলের অভিজিৎ শিবিরের সঙ্গে তৃণমূলের কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক মিহির গোস্বামীর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ওই ঘটনার ব্যাপারে মিহিরবাবু বলেন, “গত এক বছরে কোচবিহার শহরের আইন শৃঙ্খলা তলানিতে গিয়েছিল। এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে কোতোয়ালি থানার পুলিশের নিস্ক্রিয়তা দায়ী। মুখ্যমন্ত্রী আগেই বলেছেন, যারা অস্ত্র নিয়ে দাদাগিরি করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। কিছু দিন আগে আমার একটি সভা মঞ্চও ভাঙা হয়। অথচ পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। কারও বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলার নেই।”
পুলিশ সূত্রের খব র, শুভজিৎবাবুকে থানায় এনে বেশ কিছু ক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে অভিযোগে তাঁর নাম না থাকলেও পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। ধৃতের বিরুদ্ধে আইপিসির ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টা, ২৫ অস্ত্র আইন সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। আদালতে পুলিশ সাত দিনের জন্য তাঁকে নিজেদের হেফাজতে রাখার আর্জি জানায়। আদালত অবশ্য একদিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেন। শুভজিৎবাবুর আইনজীবী নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, “এজাহারে শুভজিৎ কুণ্ডুর নাম নেই। তার পরেও ওই মামলায় কেন পুলিশ গ্রেফতার করল, তা বুঝতে পারলাম না। শুভজিৎ কুণ্ডু এই ঘটনায় সম্পূর্ণ ভাবে চক্রান্তের শিকার হয়েছেন।’’