(বাঁ দিকে) অশোকবাবুকে কালো পতাকা। (ডান দিকে) গাড়ি থেকে নেমে আসার পর অশোকবাবু। শনিবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
ফের তাঁর উপর হামলার অভিযোগে সরব হলেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। শনিবার শিলিগুড়ির তিনবাতি এলাকায় তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা কালো পতাকা নিয়ে অশোকবাবুর গাড়ির উপর চড়াও হয় বলে অভিযোগ। তবে তাঁর দেহে কোনও আঘাত লাগেনি বা তাঁর গাড়িরও কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন মেয়র।
এ দিন বিকেলে তিনবাত্তির প্রাথমিক স্কুলের মাঠে বস্তি উন্নয়ন সমিতির জেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশ্য সভা ছিল। সেই সভার প্রধান বক্তা ছিলেন মেয়র অশোকবাবু। এ দিন সকালেই কোচবিহারের মাথাভাঙায় দলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের ছোট গাড়িতেই অশোকবাবু কোচবিহারে গিয়েছিলেন। অভ্যাস মতো গাড়ির সামনের আসনেই বসেছিলেন অশোকবাবু। মেয়র এবং প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবে অশোকবাবু পুলিশের নিরাপত্তা পান। পিছনের আসনে উর্দি পড়েই সেই পুলিশকর্মী বসেছিলেন। অশোকবাবুর গাড়ির সামনে ‘মেয়র’ লেখা বোর্ডও রয়েছে। চকোলেট রঙের গাড়িটি তিনবাতি মোড়ে পৌঁছতেই জড়ো হয়ে হয়ে থাকা তৃণমূল কর্মীরা গাড়ি আটকে দেয় বলে অভিযোগ।
সিপিএমের অভিযোগ এ দিন বিকেল থেকেই তাঁদের সভাস্থলের কাছে তৃণমূলকর্মীরা জড়ো হয়েছিল। সে কারণে গোলমালের আশঙ্কায় দলের নেতা দিলীপ সিংহ, নুরুল ইসলামরা একাধিকবার পুলিশ কমিশনার সহ অন্য অফিসারদের ফোন করেন। কিন্তু কেউ ফোন তোলেননি। অশোকবাবুর গাড়ি দেখেই, কালো পতাকা, রড, লাঠি নিয়ে হামলাকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘হামলাকারীদের হাতে কালো পতাকা ছিল। কারও হাতে লোহার রড়, লাঠি এমনকী টাঙ্গি ছিল। আমি গাড়ি থেকে নামতে চেয়েছিলাম, নামলে হয়ত প্রাণেই বাঁচতাম না।’’ অশোকবাবুর দাবি, হামলার সময়ে দলের কর্মীরা এগিয়ে আসাতেই তাঁর কোনও আঘাত লাগেনি, এবং গাড়িতেও বড়সড় কোনও ক্ষতি হয়নি।
তাঁর অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দার্জিলিঙের জেলা সভাপতি গৌতম দেবের মদতে এমন হামলা হয়েছে। তিনি সে কথা পুলিশকেও জানিয়েছেন। তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এই অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, ‘‘হামলা হলে গাড়িতে আঘাতের ন্যূনতম চিহ্ন থাকত। উনি তো নিজেই বলছেন দেহে আঘাত লাগেনি। তা হলে হয়তো ওঁর হৃদয়ে অদৃশ্য আঘাত লেগেছে।’’ মন্ত্রীর সংযোজন, অশোকবাবু প্রচারের আলোয় থাকতে মরিয়া হয়ে বারবার এমন মনগড়া অভিযোগ করছেন।
গত ১৫ অগস্ট মাটিগাড়াতে দলের একটি সভায় যোগ দিতে গিয়ে তিনি হামলার মুখে পডেন বলে অশোকবাবুর অভিযোগ। দু’সপ্তাহের মধ্যে ফের তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। অশোকবাবুর অভিযোগ, পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালানো হয়, সে কারণেই শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার থেকে অনান্য অফিসারদের ফোন করলেও, কেউ ফোন ধরেননি। মেয়র তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোকবাবুর উপর হামলার প্রতিবাদে এ দিন রাতেই শিলিগুড়িতে মিছিল করে সিপিএম। আজ, রবিবার এবং সোমবার প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে বলে জেলা সিপিএম ঘোষণা করেছে। সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার অসুস্থতার কারণে নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকেই তিনি ফোনে বলেন, ‘‘শিলিগুড়িতে এমন হামলার সংস্কৃতি ছিল না। নিন্দার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’’
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ তদন্ত হবে। একটি অনুষ্ঠানে থাকায় অশোকবাবুর ফোন টের পাইনি। পরে জেনেছি, তিনবাত্তি এলাকায় দলের সভা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অশোকবাবু ফোন করেছিলেন।’’ পুলিশ কমিশনারের কথায়, বলেন, ‘‘তিনবাতি মোড়ে মেয়রের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ, কালো পতাকা দেখানো হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। বাকিটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’
দলের চিরাচরিত ‘লাইন’ ভেঙে এবারের পুরভোটে শিলিগুড়ির মেয়র পদপ্রার্থী ‘ঘোষণা’ করেছিল সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের উপস্থিতে শিলিগুড়ি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের সভা থেকে তা ঘোষণা করা হয়। এক নির্দলের সমর্থন নিয়ে শিলিগুড়ি পুরবোর্ড দখল করে বামেরা। অশোকবাবুও মেয়র হন। বোর্ড দখলের পরে পুরসভার বোরো চেয়ারম্যান নিয়ে ভোটাভুটিতেও তৃণমূল কোনঠাসা হয়। তৃণমূলকে হারাতে একটি বোরোতে কংগ্রেসকে সমর্থন করে বামেরা। সে দিনই অশোকবাবু ঘোষণা করেছিলেন, যেখানেই সুযোগ পাবেন, তৃণমূলকে হারাতে বিরোধী শক্তি জোট বাধবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেই ঘটনাকে ‘দ্বিতীয় শিলিগুড়ি মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুরভোটের পরেই ‘উজ্জীবিত’ সিপিএম মহকুমা পরিষদ ভোটেরও প্রস্তুতি শুরু করেছে। সিপিএমের অভিযোগ, তারপর থেকেই তৃণমূলের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন অশোকবাবু।
এ দিন নিজেও অশোকবাবু বলেন, ‘‘বারবার আমাকে আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে। একদিকে পুরসভার কাজে প্রতিবন্ধকতা করছে তৃণমূল, এবং সন্ত্রাস করে ভয় দেখাতে চাইছে।’’ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্ররোচণার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেছিলেন আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াবেন, যেখানেই যাব সেখানেই বাধা তৈরি করবে। তার পর থেকেই হামলা শুরু হয়েছে। মন্ত্রী নিজে হামলার প্ররোচণা দিচ্ছে বলে পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে।’’
এ দিন অশোক ভট্টাচার্যের উপর আক্রমণের ঘটনায় তৃণমূলের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সূর্যকান্তবাবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব নাকি বলেছেন অশোক ভট্টাচার্য যেখানে যাবেন সেখানে বিক্ষোভ দেখানো হবে। আজ অশোকবাবুর উপর তৃণমূলের লোকেরা আক্রমণ করতে এসেছিল। স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধে তাঁরা পালিয়ে গিয়েছে। আমি বলছি এরপর যদি ফের অশোকবাবুর উপর আক্রমণ হয় তাহলে শুধু শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি নয় সারা রাজ্যে আরও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’’