সিঙ্গুরের সেই প্রায় দু’শো একর জমির মালিকের হদিসই নেই!

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে জমি ফেরত দিতে শুরু করেছে প্রশাসন। অথচ সিঙ্গুরের সেই প্রায় দু’শো একর জমির মালিকের হদিসই নেই!

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

ছ’একর জমির ১৭৫টি প্লটে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বীজ ছড়িয়ে গিয়েছেন। —নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে জমি ফেরত দিতে শুরু করেছে প্রশাসন। অথচ সিঙ্গুরের সেই প্রায় দু’শো একর জমির মালিকের হদিসই নেই! বারবার বলা সত্ত্বেও ওঁদের কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে বা জমির দখল নেওয়ার আবেদন জানাতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না!

Advertisement

দেখে-শুনে নবান্ন রীতিমতো তাজ্জব। কেন এমন, রহস্যটা খুঁজে বার করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এ বার তদন্ত করতে চলেছে। এর পিছনে বাম জমানার ‘অনিয়মের’ ছায়া দেখতেও শুরু করেছে প্রশাসনের একাংশ। তাদের মতে, টাটার মোটরগাড়ি কারখানার জন্য সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণকালেই ক্ষতিপূরণের চেক বিলিতে বড় ধরনের কারচুপি হয়েছিল, যার জেরে এখন কিছু জমির চেক বিডিও অফিসে পড়ে রয়েছে। কারচুপি ফাঁসের ভয়েই অনেকে জমির কাগজপত্র নিতে আসছেন না বলে এই মহলের পর্যবেক্ষণ।

কীসের জন্য কী, নবান্ন এ বার তা খুঁড়ে বার করতে চায়। সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর হাতে থাকা ৯৯৭ একর জমি মালিকদের ফেরতের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, গত ৩০ অগস্ট। এ জন্য সর্বোচ্চ আদালত তিন মাসের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে। সেই মতো কাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবারই সিঙ্গুরে গিয়ে মালিকদের জমি হস্তান্তর পর্বের (ফিজিক্যাল পজেশন) সূচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ১০ নভেম্বরের মধ্যে সব জমি কৃষক-মালিকদের দেওয়া হবে বলে মমতা জানিয়েছেন।

Advertisement

এমতাবস্থায় ওই দু’শো একরের মালিকদের নিয়ে প্রশাসনের কপালে ভাঁজ প্রকট। নবান্নের খবর: অধিগ্রহণের সময় যাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে তাঁদের অনেকে বিডিও অফিসে গিয়ে পরচা নিয়ে এসেছেন। সরকারি ভাষায, এঁরা ‘ইচ্ছুক’ চাষি। আর যাঁরা তখন ক্ষতিপূরণ নেননি, সেই ‘অনিচ্ছুক’দের সিংহভাগ ক্ষতিপূরণের টাকা ও পরচা— দুই-ই নিয়ে গিয়েছেন।

কিন্তু রায় ঘোষণার পরে গত পঞ্চাশ দিন ধরে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে প্রায় দু’শো একরের মালিককে বিডিও অফিসে দেখা যায়নি। প্রত্যেকের বাড়িতে প্রশাসনের নোটিস গিয়েছে। অন্য নানা ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছে। তবু লাভ হচ্ছে না। ওই জমির মালিকানা মোট ক’জনের হাতে?

সরকারি নথি মোতাবেক, ইচ্ছুকদের হাতে থাকা ৭০২ একরের মধ্যে একশো একরের প্রায় ২৩০০ মালিকের সন্ধান নেই। আর অনিচ্ছুকদের হাতে থাকা ২৯৫ একরের মধ্যেও প্রায় একশো একরের মালিকের হদিস মিলছে না, যাঁদের সংখ্যাটা প্রায় ৩০০।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় ২৬০০। হুগলির জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল এ দিন সিঙ্গুরে দাবি করেন, ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে ১৩ হাজার চাষির মধ্যে ক্ষতিপূরণের চেক ও পরচা নিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি। সেই হিসেবে না-নেওয়ার সংখ্যাটা প্রায় তিন হাজার। তবে চেক-পরচা এখনও দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএম।

যা-ই হোক না কেন, মোটামুটি হাজার আড়াই মালিক যে বেপাত্তা, সে সম্পর্কে প্রশাসনে দ্বিমত নেই। যার নেপথ্যে ‘দুর্নীতি’র তত্ত্ব দিচ্ছেন অনেকে। আর সেই কারণেই তদন্তের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত। বৃহস্পতিবার সিঙ্গুরের গোপালনগর মৌজায় চাষিদের সর্ষেবীজ বিলির মঞ্চে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘যাঁরা চেক বা পরচা নিতে আসছেন না, তাঁরা আসবেনও না। কারণ, সবই ছিল ভুয়ো। এ বার সরকার তদন্ত করে সব জালিয়াতি বার করবে। কেউ ছাড় পাবেন না।’’ প্রসঙ্গত সুপ্রিম কোর্টের সিঙ্গুর-রায় কার্যকরের ভার পার্থবাবুকেই সঁপেছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত দু’মাস সিঙ্গুরে ক্যাম্প করে থাকা শিক্ষামন্ত্রীর উপলব্ধি, ‘‘জমির ক্ষতিপূরণ বিলি নিয়েও বিস্তর গরমিল হয়েছে।’’

ভূমি দফতরের কর্তাদের কথাতেও মন্ত্রীর অভিযোগের প্রতিফলন। দফতরের খবর: এ সংক্রান্ত অন্তত পঞ্চাশটি অভিযোগ জমা পড়েছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, জমির প্রকৃত ‘সর্বশেষ’ মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। কী রকম?

এক ভূমি-কর্তার ব্যাখ্যা, সিঙ্গুরের ওই সব জমির কিছুটা কিছুটা বিক্রি হলেও সরকারি খাতায় মালিকের নাম বদলায়নি। সেই মওকায় অধিগ্রহণের সময় জমির পুরনো মালিকই ক্ষতিপূরণ নিয়ে চম্পট দিয়েছেন। ‘আসল’ মালিকের হাতে জমির দলিল থাকলেও সরকারি রেকর্ডে নাম না-থাকায় তিনি ক্ষতিপূরণ বা পরচা কিছুই পাচ্ছেন না।

এমন দশটি ঘটনা চিহ্নিত করে ইতিমধ্যে এফআইআর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই আধিকারিক। পার্থবাবুর মন্তব্য, ‘‘বাম জমানায় ক্ষতিপূরণ বিলির নামে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চেপেছে। এতে লাভবান কারা হয়েছে, তা খুঁজে বার করা হবে।’’ কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘সকলকে জমির পরচা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে এক সঙ্গে চাষও শুরু করা যেত। কিন্তু সিপিএমের কাণ্ডকারখানার ফল আমাদের ভুগতে হচ্ছে।’’

এ দিকে এ দিন প্রশাসনের দাবি, সিঙ্গুরের মোট ৯৯৭ একরের মধ্যে ৯৩১ একর জমিকে মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার মতো চেহারায় ফেরানো গিয়েছে। তার মধ্যে পুরো চাষযোগ্য করা গিয়েছে ২০২ একরকে।

তেমনই ছ’একর জমির ১৭৫টি প্লটে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বীজ ছড়িয়ে গিয়েছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement