• দু’শো ছাত্রকে সামলাচ্ছেন মাত্র এক জন শিক্ষক! হুগলি খানাখুলের হীরাপুর জুনিয়র হাইমাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক ছাড়া আর কোনও শিক্ষক নেই। কোনও শিক্ষাকর্মীও নেই। ২০০৯ সালে তিন জন শিক্ষক নিয়ে ক্লাস শুরু হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে দু’জন অবসর নেওয়ায় এখন প্রধান শিক্ষকই পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র সম্বল!
• কলকাতার এন্টালিতে তাঁতিবাগ গার্লস হাইমাদ্রাসায় ছাত্রী-সংখ্যা প্রায় ৩০০। শিক্ষক? তিন জন। ইংরেজি, অঙ্ক, ভৌতবিজ্ঞান, ভূগোলের শিক্ষক নেই দীর্ঘ তিন বছর। ওই মাদ্রাসায় এখন ন’টি শিক্ষকপদ খালি রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সামনের অক্টোবরে অবসর নেবেন। শূন্যতার বহর তখন আরও বাড়বে। অর্থাৎ সমস্যা বাড়তেই থাকবে পড়ুয়াদের।
• মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর ইসলামপুর সাগর হাইমাদ্রাসায় পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ১৫০০। শিক্ষক আছেন ১০ জন। ২৩টি শিক্ষকপদ খালি। জীববিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান, অঙ্ক, ইতিহাসের শিক্ষক নেই।
• বর্ধমান হাইমাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শাখা চালু হয়েছে ২০১০ সালে। কিন্তু শিক্ষক না-থাকায় ছাত্র ভর্তি করা যাচ্ছে না।
চারটি মাদ্রাসার এই শোচনীয় ছবি নিছকই উদাহরণ। শিক্ষা শিবির সূত্রের খবর, রাজ্যের ৬১৫টি মাদ্রাসার অধিকাংশেরই হাল কমবেশি এক। ছাত্রছাত্রীরা আসে-যায়। পঠনপাঠন মার খায় শিক্ষক-শূন্যতায়। সামান্য যে-ক’জন শিক্ষক আছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নিত্য গলদ্ঘর্ম হতে হয় তাঁদের। শৃঙ্খলা কোনও ভাবে রক্ষা পেলেও পড়াশোনার ক্ষতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। ছাত্রছাত্রীদের সামনে অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়।
আদালতের নির্দেশে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ তিন বছর। কমিশনের বক্তব্য, এখন প্রায় সাত হাজার পদ শূন্য। প্রায় এক হাজার শিক্ষাকর্মীর পদও খালি। ১৩২টি মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক নেই। শিক্ষকের অভাবে পঠনপাঠন শিকেয় উঠেছে। আর পর্যাপ্ত শিক্ষাকর্মী না-থাকায় মাদ্রাসা পরিচালনার কাজও লাটে ওঠার জোগাড়। কর্মচারী কম থাকায় ক্যাশবুক, মিড-ডে মিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং বিভিন্ন তহবিলে আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখা থেকে বৃত্তিপ্রদান, কন্যাশ্রী, সাইকেল দেওয়া থেকে কর্মীদের প্রতি মাসে বেতনের কাগজপত্র তৈরি করা— সব কাজেই গুরুতর সমস্যা হচ্ছে।
এই সব সমস্যার দরুন পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে বলে গত ২৭ এপ্রিল মাদ্রাসা পর্ষদ ভবনে এক কর্মশালায় অভিযোগ করেন বেশ কয়েক জন প্রধান শিক্ষক। বোর্ডের সভাপতি ফজলে রাব্বিও মেনে নেন, ‘‘শিক্ষক-সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। আমাদের মুখ দেখানোর জায়গা নেই।’’ কিন্তু এই দুরবস্থার প্রতিকার হচ্ছে না কেন? ‘‘আদালতের নির্দেশের জেরে কিছু করা যাচ্ছে না। আমরা অসহায়,’’ বলছেন ফজলে রাব্বি।
কোন নির্দেশের কথা বলা হচ্ছে? নির্দেশটি দেওয়া হয় কোন মামলায়?
মামলাটি হয়েছিল ২০১৩ সালে। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের বিরোধিতা করে মামলা ঠুকে দেয় পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি রহমানিয়া হাইমাদ্রাসার পরিচালন সমিতি। পরের বছর আদালত তাদের নির্দেশে জানায়, ওই কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করলে সেটা হবে অবৈধ। ধাক্কা খায় সরকার। পরে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে গেলে রাজ্য সরকার সেখানেও হেরে
যায়। মামলাটি আপাতত সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন।
মামলার সঙ্গেই ঝুলে আছে শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নটি। আর সেই সঙ্গে ঝুলছে পড়ুয়াদের অগ্রগতি। রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরামের সভাপতি ইসরারুল হক মণ্ডল বলেন, ‘‘মামলার জন্য তিন বছর নিয়োগ বন্ধ। সদিচ্ছার অভাবেই হাইকোর্টে হেরেছে রাজ্য সরকার।’’ মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামের জানান, শিক্ষক না-থাকায় বেশির ভাগ দিনই নির্ধারিত সময়ের আগে ছুটি হয়ে যাচ্ছে। ‘‘আমরা কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যার কথা জানিয়েছি। কবে সুরাহা হবে, জানি না,’’ বললেন রফিকুল।
কী বলছেন কর্তৃপক্ষ?
দুরবস্থার যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলে কর্তৃপক্ষ এখন সর্বোচ্চ আদালতের দোহাই দিতেই ব্যস্ত। ফলে শূন্য পদে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে পাঠ-সমস্যার সমাধান কবে হবে, কেউ জানেন না।