নোটের চোটে টান মাংস-ভাতেও

বৈধ নোটের আকাল থাবা বসাল আম বাঙালির রবিবাসরীয় মাংস-ভাতের ভোজন বিলাসেও। পাঁচশো, হাজার টাকা নোট বাতিলের পর এটা ছিল প্রথম রবিবার। আর বাঙালির সঙ্গে রবিবারের দুপুরে খাসি বা পাঁঠার মাংসের ঝোল-ভাত যেন ওতপ্রোত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৪৮
Share:

টাকার জন্য অপেক্ষা। এটিএমের সামনে লম্বা লাইন।

বৈধ নোটের আকাল থাবা বসাল আম বাঙালির রবিবাসরীয় মাংস-ভাতের ভোজন বিলাসেও। পাঁচশো, হাজার টাকা নোট বাতিলের পর এটা ছিল প্রথম রবিবার। আর বাঙালির সঙ্গে রবিবারের দুপুরে খাসি বা পাঁঠার মাংসের ঝোল-ভাত যেন ওতপ্রোত। কিন্তু নোটের সঙ্কটে কেউ কেউ মাংস কিনতেই পারলেন না, কেউ কিনলেন কম করে।

Advertisement

মাংস বিক্রেতা নুর আহমেদ লস্কর জানাচ্ছেন, গড়ে প্রতি রবিবার তিনি মাংস বিক্রি করেন ৮০ কেজির উপরে। অথচ এ দিন বিক্রি ৫০ কেজির উপরে ওঠেনি। নুরের কথায়, ‘‘যিনি সওয়া কেজি মাংস কেনেন, তিনি আজ কিনেছেন সাড়ে সাতশো গ্রাম।’’ আসলে গত কয়েক দিন নিলেও নুর এ দিন আর পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেননি। ‘‘কী করব? আমি রাজাবাজারের এক পাইকারের থেকে মাল নিই। শনিবার পাঁচশো, হাজারের নোটে ৬০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। উনি ফেরত দিয়েছেন। এর পর আমি ওই নোট নিচ্ছি না, ’’ বললেন নুর।

মাছ-মুরগি আর সবজির বাজারে রবিবার এটাই চিত্র। পাইকারি বাজার শনিবার বিকেল থেকে পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়া বন্ধ করেছে। ফলে, খুচরো বিক্রেতাদের একটা বড় অংশ রবিবার ক্রেতাদের কাছ থেকে পাঁচশো, হাজারের নোট নেননি। মানিকতলা, দমদম, বাঘাযতীন, গড়িয়াহাট, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাটে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, নোটের আকাল শুরু হওয়ার পর প্রথম রবিবার বিক্রিবাটা সব জায়গাতেই পড়ে গিয়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। গত তিন দিন যাঁরা টাকা তুলতে পেরেছেন, এ দিন মূলত তাঁরাই বাজারে গিয়েছেন, কেউ কেউ হঠাৎ করে ব্যয়কুণ্ঠ হয়েছেন। দু’দিন ব্যর্থ হওয়ার পর ব্যারাকপুরের শ্যামল চক্রবর্তী কেবল শনিবার রাতে একটি এটিএম থেকে দু’হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন। রবিবার সকালে তালপুকুর বাজার থেকে মাছ, সব্জি কিনেছেন, তবে কম কম। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধাক্কায় সব কিছুরই খরচ কমাতে হচ্ছে। খরচ করতে হচ্ছে বুঝেশুনে।’’ গড়িয়াহাট ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য শ্যামাকান্ত দে জানাচ্ছেন, রবিবার সাধারণত গড়িয়াহাটের মাছ বাজারে ১০ লক্ষ টাকার বেচাকেনা হয়, আর এ দিন হয়েছে বড়জোর ছ’লক্ষ টাকার। অনেক ছোট মাছ ব্যবসায়ী বসতেই পারেননি। অথচ বাতাসে শীত শীত ভাব আসার ফলে স্বভাবতই রকমারি মাছের জোগানে এ দিন কোনও কমতি ছিল না। টাটকা ন্যাদস, গুরজাওলি, ছোট পমফ্রেট, তোপসে, পারশে, পাবদায় বাজার ছিল ভর্তি। কিন্তু কেনার লোক কম। আবার বহু ক্রেতা দু’হাজারের নোট নিয়ে অল্প টাকার বাজার করায় মুশকিলে পড়ছেন দোকানিরা। একশোর নোট ছাড়া তাঁদের কাছে খুচরো করার বিকল্প নেই। ‘‘কিন্তু তিন-চার জন খদ্দেরকে দু’হাজারের নোট ১০০ টাকায় খুচরো দেওয়ার পরেই তো ক্যাশবাক্স খালি হয়ে যাবে,’’ বলছেন আজাদগড়ের ব্যবসায়ী দেবাশিস রায়। মানিকতলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহকারী সম্পাদক বাবলু দাস বলেন, ‘‘রবিবার ছুটির দিনে সাধারণত থলে ভর্তি বাজার করেন ক্রেতারা। আজ সেটা হয়নি।’’ মনের মতো বাজার করার জন্য একে নগদ কম, তার উপর ঘরে বাজার ফেলে ছুটে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে ব্যাঙ্ক, এটিএমের লাইনে।

Advertisement

মুরগি বিক্রেতা প্রদীপ নস্করের কাছ থেকে তাঁর এক নিয়মিত খদ্দের এ দিন সকাল সওয়া সাতটায় তিন কেজি মুরগি কিনলেন ৩৯০ টাকায়। ওটাই প্রদীপবাবু বউনি। কিন্তু সেই ক্রেতার কাছে ৫০০ টাকার নোট। চেনা লোক বলে তাঁকে প্রদীপবাবু পরে টাকা দিতে বলেন। তবে বউনির সময় বলে ওই ক্রেতা তখনকার মতো ১০ টাকার একটি নোট ধরালেন দোকানদারকে। বাড়ি ফিরে এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলে সওয়া ১১টা নাগাদ দাম মেটালেন একশোর নোটে।

বৈধ টাকার আকালে সুনসান মাছের বাজার। নিজস্ব চিত্র।

নোট পেতে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের লাইনে দাঁড়ানোও এই রবিবারের বাজার মার খাওয়ার অন্যতম কারণ। আজ, সোমবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। গত তিন দিন যাঁরা টাকা তুলতে পারেননি, তাঁরা এ দিন টাকা পেতে যেন ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন। আর যার পরিণাম, বিক্রিতে ভাঁটা। দক্ষিণ কলকাতার এক খুচরো মাছ ব্যবসায়ী দানিশ মণ্ডল বললেন, ‘‘অন্য রবিবার বেলা ১১টার মধ্যে ১৩-১৪ হাজার টাকার বিক্রি হয়, আর এ দিন মেরেকেটে পাঁচ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে।’’ কলকাতার বাজারগুলোর মাছের বড় অংশ আসে হাওড়ার মাছের আড়ত থেকে। সেখানে আর পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেওয়া হবে না বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ শহরতলির বহু বাজারে মাছ যায় বাঘাযতীনের আড়ত থেকে। এ দিন সেই আড়তও বলে দিয়েছে, পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেবে না। ফলে, বাঁশদ্রোণী সুপার মার্কেটের মৎস্য ব্যবসায়ী বাবু দাস এ দিন সব মিলিয়ে ৬০ কেজি মাছ তুলেছিলেন। অন্য রবিবার তোলেন ৮০ কেজি।

পাইকারি সব্জি বাজার কোলে মার্কেটের ব্যবসায়ী, চাষিরা শনিবার পর্যন্ত ৫০০, হাজারের নোট নিলেও রবিবার জানিয়ে দেন, অচল নোট আর নেবেন না। ফলে ধাক্কা খেয়েছে রবিবারেরর সবজির বাজার। ব্যবসায়ী বুদ্ধদেব পাল বলেন, ‘‘অন্য রবিবারের তুলনায় বিক্রি অন্তত ২০ শতাংশ কম হয়েছে। রবিবার বেগুন, ঝিঙে, পটল সব ৩০ কেজি করে তুলি। আজ ২০ কেজির বেশি তুলিনি। তাও পড়ে আছে।’’ তবে এই বাজারে বিক্রেতার একাংশ বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়মিত খদ্দেরদের থেকে অচল নোটে দাম নিচ্ছেন। কোনও ব্যবসায়ী অচল নোট নিচ্ছেন বিক্রি বাড়াতে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আমাদের পরিবারের সব সদস্যের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখানে টাকা জমা দেব ধীরেসুস্থে। এই ফাঁকে ব্যবসাটা তো বাড়িয়ে নিই।’’ রানিকুঠি মোড়ের একটি মুদির দোকান এই সুবিধে দিচ্ছে। এ দিন সকালে দমদম স্টেশন সংলগ্ন মাছ বাজারের কয়েক জন ব্যবসায়ী ক্রেতাদের উদ্দেশে হাঁক দিলেন, ‘‘ব্যাঙ্কে কেন কষ্ট করে যাবেন? পাঁচশো-হাজারের নোট আমাদের দিন, মাছ কিনুন।’’ ফলে, এক রকম চোখের পলকে উড়ে যাচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরের গলদা, চাপড়া চিংড়ি, তোপসে, ট্যাংরা, কাজরি। মানিকতলার মাছ ব্যবসায়ী সঞ্জয় বৈদ্যের কথায়, ‘‘মাছ তো বিক্রি না করে ফেলে রাখতে পারব না। ৩০০ টাকার মাছ কিনলেই ৫০০ টাকার নোট ভাঙিয়ে দিচ্ছি।’’ নোটের আকালে ব্যবসা মার খাচ্ছে বলে বেহালা বাজারে এ দিন কয়েক জন ব্যবসায়ী আড়াইশো টাকা কেজি দরে টাটকা কাটা পোনা বিক্রি করেছেন। যার দাম সাড়ে তিনশো-চারশো টাকা থাকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘‘অনেকটা মাছ আগে তুলে রাখা ছিল। এখন বিক্রি না হলে নষ্ট হবে। আবার বরফ চাপা দেওয়ার খরচও কম নয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement