ডায়ালিসিস চলাকালীন হঠাৎই ছটফট করে উঠলেন বৃদ্ধা রোগিণী। প্রথমে কেউ বিষয়টা খেয়াল করেননি। যখন নজরে পড়ল ছুটে এলেন বাড়ির লোকেরাও। কাতর হয়ে তাঁরা বললেন, ‘‘দয়া করে ডাক্তারকে ডাকুন।’’
কিন্তু কোথায় ডাক্তার? পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে চলা ডায়ালিসিস ইউনিটে কোনও ডাক্তারই নেই। বহু চেষ্টাচরিত্র করে ওই পিপিপি ইউনিটেরই অন্য একটি বিভাগ থেকে ডেকে আনা হল এক ডাক্তারকে। রোগিণীকে পরীক্ষা করার পরে তিনি জানিয়ে দিলেন, কিছু ক্ষণ আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
বাড়ির লোকেরা ডেথ সার্টিফিকেট চাইলেন। কিন্তু কে দেবেন ডেথ সার্টিফিকেট? সেই ডাক্তার সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘‘আমি তো এই ইউনিটের কেউ নই। আমি কী ভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দেব?’’ তা হলে কে দেবেন? যে জেলা হাসপাতালে ওই পিপিপি ইউনিটটি চলছে, সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন বাড়ির লোকেরা। তাঁরা জানালেন, এটা তো পিপিপি ইউনিটের ব্যাপার। হাসপাতাল কেন এর মধ্যে জড়াবে?
টানা ঘণ্টা ছয়েক ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত এক পরিচিত ডাক্তারের হাতেপায়ে ধরে কোনও মতে ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করে ওই বৃদ্ধাকে দাহ করার ব্যবস্থা করেন বাড়ির লোকেরা।
ঘটনাটি পশ্চিম মেদিনীপুরের তমলুক হাসপাতালের। রবিবার দিনভর সেখানেই মিনতি মাইতি নামে এক রোগিণীকে নিয়ে চূড়ান্ত নাজেহাল হয়েছেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। আর তাঁদের এই ভোগান্তি আরও এক বার আঙুল তুলেছে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার এক বড়সড় অব্যবস্থার দিকে। মিনতিদেবীর ছেলে সঞ্জয় মাইতি বলেন, ‘‘আমরা, রোগীর পরিবারের লোকেরা কী ভাবে জানব কোথায় ডাক্তার রয়েছেন, কোথায় নেই? যদি জানতাম, তা হলে হয়তো সর্বসান্ত্ব হলেও অন্য কোনও কেন্দ্রে নিয়ে যেতাম। তা হলে এ ভাবে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মা-কে চলে যেতে হত না।’’
কথায় বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না। সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া পিপিপি মডেলের ডায়ালিসিস ইউনিটে যে কোনও রোগীর অবস্থাই ভাগের-মায়ের মতো।
এই মুহূর্তে রাজ্যে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এক লক্ষেরও বেশি রোগীর ডায়ালিসিস প্রয়োজন হয়। কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও এসএসকেএমে ১৫টি, আরজিকরে ছ’টি, নীলরতন সরকারে চারটি এবং কয়েকটি জেলা হাসপাতালে ১৯টি সহ গোটা রাজ্যে মাত্র ৪৪টি ডায়ালিসিস যন্ত্র ছিল। ফলে ডায়ালিসিসের প্রয়োজন রয়েছে এমন অসংখ্য রোগী পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালিসিস যন্ত্রের সংখ্যা ৪০০-র বেশি থাকলেও সামর্থ্যের অভাবে সেই পরিষেবা নিতে পারেন না অনেকেই।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্য জুড়ে পিপিপি মডেলে ডায়ালিসিস ইউনিট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী রাজ্যের বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে গড়ে ওঠে ডায়ালিসিস ইউনিট। কিন্তু তার কোনওটিতেই ডাক্তার নেই। শুধুমাত্র টেকনিশিয়ানরাই কাজটা করেন। ফলে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ইউনিট থেকে নানা ধরনের সমস্যার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টা যে কত দূর গড়াতে পারে, রবিবার তমলুক হাসপাতালের ঘটনা তারই প্রমাণ বলে মেনে নিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশও।
এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকার পরিণতি এমনই হবে। ডায়ালিসিস চলাকালীন রোগী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিণতি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ডাক্তার তো এই সব কেন্দ্রে থাকেনই না, এমনকী, যে টেকনিশিয়ানরা থাকেন, তাঁরাও সকলে প্রশিক্ষিত কি না সে নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।’’ তা হলে ইউনিটগুলো খোলা হল কেন? তাঁর জবাব, ‘‘ইউনিট চালু করা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। আমরা বাধা দেওয়ার কে?’’
এমন একাধিক ইউনিটের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, নিয়মিত কেন্দ্রে ডাক্তার রাখার জন্য যে খরচ তা তাঁরা বহন করতে রাজি নন। এমনই এক কেন্দ্রের কর্তা বলেন, ‘‘বেসরকারি ক্ষেত্রে ডায়ালিসিসের যা খরচ, তার চেয়ে পিপিপি ইউনিটে অনেক কম খরচে আমাদের করতে হয়। এর পর ডাক্তার রাখতে গেলে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাবে। তা ছাড়া আমাদের ডাক্তার রাখার কথাও নয়। ইউনিট চালুর সময়েই আমরা সরকারকে স্পষ্ট জানিয়েছিলাম, টেকনিশিয়ানরাই কাজটা করবেন।’’
ইউনিটের কর্তারা যা-ই বলুন, নেফ্রোলজিস্টদের বক্তব্য অনুযায়ী, মানুষের ডায়ালিসিসের সময়ে ডাক্তারের উপস্থিতি সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক। ডাক্তার ছাড়া ডায়ালিসিস ইউনিট চালানোটাই নিয়মবহির্ভূত। নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার বলেন, ‘‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ নেফ্রোলজির গাইডলাইন দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ’’
এমন একটা অনিয়ম তাঁরা কী ভাবে চলতে দিচ্ছেন? পিপিপি মডেলে ডায়ালিসিস প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডের বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার তো আর ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ নেফ্রোলজির বিধান মেনে চলবে না। আমরা রাজ্য সরকারের নিজস্ব বিধানে চলব।’’ এক জন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর বিধান কী বলে? রাজেনবাবু বলেন, ‘‘আমি এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেব না।’’