সাপের ছোবলে মৃত্যু হলে নিয়ম অনুযায়ী পরিবার পিছু ১ লক্ষ টাকা করে দিতে হয় রাজ্য সরকারকে। সেই হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৮ কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে সরকারি কোষাগার থেকে। অথচ সেই মৃত্যু কমিয়ে আনতে সরকারেরই কোনও হেলদোল নেই।
সাপে কামড়ানোর পরে কী করা উচিত, তা নিয়ে একটি নির্দেশিকা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের বেশির ভাগ হাসপাতালে তা টাঙানো নেই বলে অভিযোগ করেছেন রাজ্যেরই এক স্বাস্থ্য আধিকারিক। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, সেই নির্দেশিকাতেই লেখা রয়েছে, বিষধর সাপে কামড়ানোর এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে পরিমাণ মতো ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগী বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সাপে কামড়ানো রোগীকে যখন হাসপাতালে আনা হচ্ছে, তত ক্ষণে বিষ তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কারণ সাপে কাটার পরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কুসংস্কারবশত ওঝা, গুণিনের কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করছেন রোগী বা তাঁর পরিবারের লোক।
ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক সমরেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘‘গত তিন বছরে ক্যানিং হাসপাতালে সাপের কামড়ে মৃত ২০ জনের মধ্যে ১৬ জনই প্রথমে ওঝার দ্বারস্থ হয়েছিলেন।’’ আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক যুধিষ্ঠির দাসও জানাচ্ছেন, গত তিন বছরে ওই হাসপাতালে ১০ জন এমন রোগী মারা গিয়েছেন। এঁরাও সবাই প্রথমে ওঝাদের কাছে গিয়েছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক শুভেন্দু বাগের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এলাকার ৯০ শতাংশ সাপে কামড়ানো রোগী চিকিৎসা করাতে প্রথমে ওঝার কাছে যান। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় স্বাস্থ্যেকেন্দ্রে ছুটে আসেন।’’
এমন উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। পাথরপ্রতিমার হিমাংশু গায়েন (৫৫)-কে রাতে ঘুমের মধ্যেই সাপে কামড়েছিল। ভোরবেলায় তিনি ওঝার কাছে যান। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওঝাই শেষে হাসপাতালে পাঠান। পরের দিন সকালে পাথরপ্রতিমা ব্লক হাসপাতালে মারা যান হিমাংশুবাবু।
কোচবিহারের পুণ্ডিবাড়ির বাসিন্দা বৃষ্টি রায় (৫০) সকালে গাছ থেকে ফুল তোলার সময়ে পায়ে গোখরোর ছোবল খান। ওঝার কাছে গিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ ঝাড়ফুঁকের পরেও তাঁর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ওঝা হাসপাতালে যেতে বলেন। কোচবিহার জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে মারা যান বৃষ্টিদেবী। ক্যানিংয়ের জীবনতলার বাসিন্দা লক্ষ্মী মুন্ডাকে (৫৪) রাতে সাপে কামড়ায়। রাতেই ছুটে যান একটি খ্রিস্টান মিশনে। ক্ষতস্থানে ক্রস আঁকা পাথর বসিয়ে বলা হয় ওই পাথর সব বিষ শুষে নেবে। সারা রাত ওই ভাবে বাড়িতে কাটানোর পরে বিপদ বুঝে পরদিন সকালে ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হন লক্ষ্মী। ওই দিনই সকালে মারা যান তিনি। রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর জানাচ্ছে, ঠিক এ ভাবেই ২০১৩-১৪ সালে সাপের কামড়ে ৭৭৬ জন, ২০১৪-১৫ সালে ৮১৬ জন এবং ২০১৫-১৬ সালে ৮২৭ জন মারা গিয়েছে। আর প্রতিটি পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, এক সময় ব্লক ও জেলা স্তরের হাসপাতালে সাপে কামড়ানোর প্রতিষেধক এভিএস (অ্যান্টি ভেনাম সিরাম)-এর অভাব ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে এখন রাজ্যের সব হাসপাতালেই ওই ওষুধ পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। অথচ হাসপাতালে না গিয়ে প্রথম কয়েক ঘণ্টা ওঝার কাছে কাটিয়ে দিচ্ছেন আক্রান্তরা। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে সাপে কাটার চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার ঘোচেনি। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, গত তিন বছরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সাপের কামড়ে মৃতদের ৯০ শতাংশ প্রথমেই ওঝা, গুণিনের শরণাপন্ন হয়েছেন।’’
ক্যানিংয়ের যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘সরকারি নজরদারির অভাবে রাজ্যজুড়ে ওঝা, গুণিনরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’’ সাপে কামড়ানো রোগীকে হাসপাতালমুখী করতে এবং ওঝাদের সচেতন করতে তাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছেন বিজনবাবুরা।
যে সব ওঝাকে তাঁরা এত দিন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাঁদেরই এক জন ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা, তাবিল জমাদারের কথায়, ‘‘গত দু’বছরে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর সাপে কামড়ানো রোগী এলেই তাঁদের হাসপাতালে যেতে বলি। কিন্তু অনেক বলা সত্ত্বেও তাঁরা কিছুতেই হাসপাতাল যেতে চান না।’’ গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে সরকারি তরফে এখনও সে রকম কোনও উদ্যোগ নেই — অভিযোগ করছেন খোদ ওঝাই।