প্রকল্পের ছাড়পত্র মিলেছিল ২০০৬-এ। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক চওড়া করতে জমি চেয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল তারও তিন বছর পরে, ২০০৯-এ। কিন্তু ২০১৬ সালে এসেও ওই কাজ শেষ করে উঠতে পারলেন না জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই)। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখন কোথাও নির্মাণ সংস্থাকে এককালীন ঋণ দিয়ে, কোথাও রাস্তার কিছু অংশের দায়িত্ব রাজ্যের হাতে সঁপে বাকি কাজ শেষ করতে চাইছে এনএইচএআই.
কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘আগে সমস্ত জাতীয় সড়ক একাই বানাত এনএইচএআই। পরবর্তী কালে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সরকারের যৌথ প্রকল্প (পিপিপি মডেল) জনপ্রিয় হলে বছর ছয়েক ধরে সে ভাবেই দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সেখানে জমির দাম মেটাচ্ছে এনএইচএআই। সড়ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পেওকাজ হচ্ছে পিপিপি-তে।’’
মন্ত্রক সূত্রের খবর, বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন কিছু যৌথ প্রকল্পের সমীক্ষা করে এনএইচএআই দেখেছে, নির্মাণ সংস্থার
গাফিলতিতেই যে সব ক্ষেত্রে কাজে ঢিলে পড়েছে, তা নয়। কোথাও জমি পেতে দেরি হয়েছে, কোথাও ঋণদাতা সংস্থা মাঝপথে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে, কোথাও বা পরিবেশের ছাড়পত্র পেতেই দীর্ঘ সময় লেগেছে। ফলে সেই সব প্রকল্পে সময় মতো কাজ শুরু করা তো যায়ইনি, উল্টে প্রকল্প-খরচ বেড়ে যাওয়ায় গাঁটের কড়ি গুনে ব্যাঙ্কের সুদ মেটাতে হয়েছে নির্মাণ সংস্থাগুলিকে। এতেই বেশ কিছু সংস্থা আর কাজ করবে না বলে জানিয়ে দেয় এনএইচএআইকে।
একাধিক নির্মাণ সংস্থার এই পদক্ষেপে প্রমাদ গোনে সড়ক মন্ত্রক। এনএইচএআই-এর এক কর্তা বলেন, ‘‘সব দিক বিবেচনা করে বছরখানেক আগে সড়ক মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নেয়, যে সব যৌথ প্রকল্পে ৫০ শতাংশের বেশি কাজ এগিয়ে গিয়েছে, অথচ নির্মাণ সংস্থা অর্থের সংস্থান করতে পারছে না, তাদের এককালীন ঋণ দেওয়া হবে। প্রকল্পের স্বার্থে গোটা দেশে এ পর্যন্ত ১৬টি নির্মাণ সংস্থাকে এমন ঋণ দেওয়া হয়েছে।’’
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প এমনই একটি উদাহরণ। গোটা প্রকল্প পাঁচ অংশে ভাগ করে একাধিক নির্মাণকারী সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজে নামে এনএইচএআই। কিন্তু ২০১২ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ২৩৯০ একরের মধ্যে মাত্র ৯০ একর জমি হাতে পায় তারা। ২০১৩ থেকে যা-ও বা জমি মিলতে শুরু করে তত দিনে প্রকল্প-খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। সড়ক মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ সংস্থা আর্থিক টানাটানির কথা জানিয়ে ২০১৪-এর অগস্টে কাজ বন্ধ করে দেয়। যে হেতু ওই অংশে ৫২ শতাংশ কাজ এগিয়ে গিয়েছে, তাই তাদের ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে এনএইচএআই।’’ সূত্রের খবর, এতে ফের কাজে নামতে রাজি হয়েছে নির্মাণ সংস্থাটি। ২০১৭-র জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে তাদের।
কৃষ্ণনগর-বহরমপুরের পাশাপাশি গেরো কাটতে চলেছে বারাসত-কৃষ্ণনগর অংশেরও। সূত্রের খবর, ওই অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে ঠিকাদার সংস্থাকে, কাজে ঢিলেমির অভিযোগে এ বছরের মে মাসে তাকে বাতিল করে এনএইচএআই। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর কোনও বেসরকারি সংস্থা নয়, এ ক্ষেত্রে রাজ্যের পূর্ত দফতরই বাকি কাজ করে দেবে। কিন্তু কেন নজির ভেঙে জাতীয় সড়ক তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে পূর্ত দফতরকে? নবান্নের এক কর্তা বলেন, ‘‘বারাসত-কৃষ্ণনগর অংশে কাজ থমকে গিয়েছে দেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে ওই অংশের দায়িত্ব রাজ্যের হাতে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সড়কমন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর।’’ আর তার পরেই সড়ক মন্ত্রকের সবুজ সঙ্কেত মেলে। পূর্ত দফতর কাজ করলেও অর্থ জোগাবে এনএইচএআই।
তবে এতেও সমস্যা পিছু ছাড়ছে না এনএইচএআই-এর। কেন? সংস্থা সূত্রের খবর, রায়গঞ্জ-ডালখোলা অংশে ৯৫ শতাংশ জমি পাওয়া গেলেও সংশ্লিষ্ট নির্মাণ সংস্থা প্রকল্প রূপায়ণে আরও বেশি টাকা দাবি করেছে। এনএইচএআই-এর কাছে ওই সংস্থার আর্জি, জমি-সমস্যায় বহু দিন কাজ আটকে থাকায় বিস্তর সুদ গুনতে হয়েছে। এখন ব্যাঙ্কও টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। এই অবস্থায় এনএইচএআই ঋণ না দিলে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এই টানাপড়েনেই ২০১২-র মাঝামাঝি থেকে রায়গঞ্জ থেকে ডালখোলা অংশে কাজ থমকে রয়েছে। এনএইচএআই অবশ্য নির্মাণকারী সংস্থার দাবি মানতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য, যে প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ হয়েছে, কেবল তাদেরই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রায়গঞ্জ-ডালখোলা অংশে ১০ শতাংশেরও কম কাজ হয়েছে। ফলে ঋণ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এনএইচএআই সূত্রের খবর, ২৩ নম্বর জাতীয় সড়কের মাঝের দু’টো অংশ— বহরমপুর-ফরাক্কা এবং ফরাক্কা-রায়গঞ্জের কাজ মোটামুটি শেষ। সেখানে টোল আদায়ও শুরু হয়ে গিয়েছে। তার পরেও গোটা প্রকল্পের কাজ কত দিনে শেষ হবে, নিশ্চিত করে বলতে পারছে না এনএইচএআই।