ওরা যদি পায়, আমরা কেন নয়!
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সিঙ্গুরের জমি ফেরত পাচ্ছেন কৃষকেরা। এই ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে এ বার জমি ফেরত পেতে রাজ্য সরকারের দ্বারস্থ হলেন নিউ টাউনের কৃষকেরা। এঁদের অভিযোগ, নিউ টাউন তৈরির সময় বামফ্রন্ট সরকার জোর করে হাজার হাজার একর চাষের জমি অধিগ্রহণ করেছিল। সিঙ্গুরের মতো এখানেও সিংহ ভাগ জমিই ছিল তিন ফসলি। সোমবার প্রায় দেড় হাজার কৃষক নিউ টাউনের হিডকো অফিসে এসে জমি ফেরতের আবেদনপত্র জমা দেন। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার জন্য এ দিন সকাল ১১টা থেকে হিডকো ভবনের সামনে ভিড় করেন চাষিরা।
সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইচ্ছুক অনিচ্ছুক— দু’ধরনের কৃষকই জমি ফেরত পাচ্ছেন। তার ভিত্তিতেই নিউ টাউনের আকন্দকেশরী, হাতিশালা, যাত্রাগাছি, কদমপুকুরের মতো মৌজায় জমি ফেরত পাওয়ার দাবি জোরদার হয়েছে। এ দিন যাঁরা হিডকোর সামনে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সে সময় ক্ষতিপূরণের চেক নেননি। অনেকে আবার চেক নিয়েছিলেন, কিন্তু এখন জমি ফেরত চান। এঁদেরই একজন গোপালপুর মৌজার রশিদ আহমেদ মণ্ডল বলেন, ‘‘আমার সাত বিঘে জমি নেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে আমার জমি অধিগ্রহণ হয়। সেই সময় গোপালপুরে জমির দর ছিল কাঠা প্রতি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম টাকায় জমি নেওয়া হয়েছিল।’’
তখন চেক নিয়েছিলেন কেন? রশিদের কথায়, ‘‘সরকার জমি নিতই। বিরোধিতার কোনও সুযোগ ছিল না। গ্রামে গ্রামে গিয়ে সিপিএমের গুণ্ডাবাহিনী ভয় দেখাচ্ছিল। তাই চেক নিতে বাধ্য হই।’’
আবেদনকারী কৃষকেরা জানান, সিঙ্গুরের রায়ের পরেই তাঁরা বিভিন্ন মৌজার জমিহারাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ঠিক হয়, সোমবার হিডকো অফিসে জমি ফেরতের আবেদনপত্র জমা দেওয়া হবে। সেই মতো নিজেরাই একটি আবেদনপত্র ছাপিয়ে বিভিন্ন মৌজায় বিলি করেন। এ দিন ২৩টি মৌজা থেকে লোকজন এসেছিলেন বলে দাবি কৃষকদের।
নিউ টাউন তৈরির জন্য ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনে জমি নেওয়া হয়েছিল। একই আইনে সিঙ্গুরেও জমি নেওয়া হয়। তবে সিঙ্গুরে অধিগ্রহণের পদ্ধতি ঠিক ছিল না বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই প্রসঙ্গ তুলেই এ দিন বনমালিপুরের উদয়ন মণ্ডল, কার্তিক মণ্ডল, নীলকান্ত নস্করদের দাবি, ‘‘এখানেও তো জোর করে জমি নেওয়া হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো নিজেই ২০১১-র বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসে অনেক জমির ফাইল দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজারহাটের জমি ফেরত দেওয়া হবে। আমাদের আশা, উনি কথা রাখবেন।’’
সরকারি সূত্রের খবর, নিউ টাউন তৈরির জন্য ১৯৯৫ থেকে অধিগ্রহণ শুরু হয়। তখন ওই সব জায়গা ছিল রাজারহাট বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। ২০০২-০৩ পর্যন্ত অধিগ্রহণ চলে। যে সময় অধিগ্রহণ শুরু হয়, তখন রাজারহাটের বিধায়ক ছিলেন সিপিএমের রবীন মণ্ডল। ২০০১-এ তিনি তৃণমূলের তন্ময় মণ্ডলের কাছে হেরে যান। ২০০৬-এ রবীন মণ্ডল ফের জিতলেও পরের দু’টি ভোটে সিপিএম এই আসনটি আর ফিরে পায়নি। রাজারহাট এলাকা এখন তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত।
তা হলে রাজারহাট নিয়ে কেন কোনও বড় আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি?
তন্ময়বাবু জানান, যখন অধিগ্রহণ শুরু হয়, তখন তৃণমূল তৈরি হয়নি। তাঁর দাবি, ‘‘ সে সময় কংগ্রেসের তরফে আন্দোলনের তেমন উদ্যোগ ছিল না। কৃষকদের নিষেধ করা সত্ত্বেও তাঁরা অনেকেই চেক নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে যখন তৃণমূল হল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার জমিহারাদের ফাইল চেয়েছিলেন। সেই ফাইল তাঁকে আমি পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরে মমতাদি আর কোনও উদ্যোগ নেননি।’’
নিউ টাউন বর্তমানে পুরোদস্তুর একটি শহর। তবে এখনও তার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সেখানে নতুন করে কোনও জমি অধিগ্রহণ না করা হলেও বাম আমলে অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত জমি নেওয়ার পর্ব চলছে। এ জন্য বিভিন্ন সময় নোটিসও দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফে।
এই অবস্থায় কী করে জমি ফেরানো সম্ভব?
রাজারহাটের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডলের কথায়, ‘‘মমতা এখানকার কৃষকদের আশা দিয়েছেন যে ওঁদের জমি ফিরিয়ে দেবেন। এ বারে তিনি বুঝবেন, কী ভাবে কী করবেন!’’ এ দিন কৃষকদের নেতৃত্বে থাকা রাজ্য কংগ্রেসের সম্পাদক শেখ নিজামুদ্দিন বলেন, ‘‘যে সব জায়গায় জমিতে নির্মাণের কাজ হয়ে গিয়েছে, আমরা সেখানে চলতি বাজার দর অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চাইছি। আর অধিগৃহীত বিপুল পরিমাণ জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সেই সব জমি এখনও চাষের যোগ্য। সেগুলি ফেরত দেওয়া হোক।’’
সিঙ্গুরের মতো তাঁরাও কি আদালতে যাবেন?
নিজামুদ্দিনের দাবি, ‘‘আন্দোলনের স্বার্থে যেখানে যেতে হয় যাব। এ দিন প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হিডকোর কাছে জমি ফেরতের আবেদন করলাম।’’
জমি ফেরানোর আবেদন নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন। নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘আমার কাছে কোনও খবর নেই। শুনিনি। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’ তা হলে চাষিদের আবেদনপত্র কী করে জমা নেওয়া হল? মন্ত্রীর উত্তর, ‘‘আমি জানি না।’’
এক সরকারি শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘সিঙ্গুরে একটি ব্যক্তিগত মালিকানাকে প্রাধান্য দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু নিউ টাউন একটা শহর। সেটা মানুষের স্বার্থে তৈরি। ফলে সেখানে অধিগৃহীত জমি ফেরতের প্রশ্নই নেই।’’