বিজেপিকে ঠেকাতে নয়া কৌশল মমতার, ফের কাছাকাছি কংগ্রেস-তৃণমূল

অল্প সময়ের জন্য হলেও বাংলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক তিক্ততা তৈরি হয়েছিল দুই শিবিরেই। কিন্তু অচিরে তার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ফের কাছাকাছি আসতে পারে কংগ্রেস-তৃণমূল।

Advertisement

দেবারতি সিংহচৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪২
Share:

দলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার কালীঘাটে। — নিজস্ব চিত্র

অল্প সময়ের জন্য হলেও বাংলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক তিক্ততা তৈরি হয়েছিল দুই শিবিরেই। কিন্তু অচিরে তার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ফের কাছাকাছি আসতে পারে কংগ্রেস-তৃণমূল। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার তথা বিজেপি-কে ঠেকাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পাওয়ার আগ্রহ বরাবরই ছিল সনিয়া-রাহুলের। এ বার সেই একই স্বার্থে প্রতি আগ্রহ দেখানোর ইঙ্গিত দিলেন তৃণমূল নেত্রীও।

Advertisement

শনিবার তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে দলের নেতাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মমতা। সূত্রের খবর, সেখানেই দিদি বলেন, শুধু বাংলায় নয়, বিজেপি-র মোকাবিলা করতে হবে দিল্লিতেও। সে জন্য একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে। কীভাবে সেই ফ্রন্ট গড়ে তোলা যাবে তার কৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর পরই মমতা বলেন, আগের তুলনায় কংগ্রেস এখন দুর্বল ঠিকই। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে কোনও শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠন করা সম্ভব নয়। তাই সমন্বয় করে চলতে হবে কংগ্রেসের সঙ্গেও। সংসদের ভিতরে ও বাইরে কংগ্রেস এবং অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে সমন্বয় রাখার সেই দায়িত্ব তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়ার কথাও এ দিন ঘোষণা করেন মমতা।

তৃণমূলনেত্রীর এই সিদ্ধান্ত জাতীয় রাজনীতির পক্ষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ভাই ফোঁটার পর নভেম্বরে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বসার কথা। মোদী সরকারের সাম্প্রতিক একাধিক পদক্ষেপ ও নীতির বিরুদ্ধে আসন্ন এই অধিবেশন থেকেই কংগ্রেস ও তৃণমূলকে কক্ষ সমন্বয় করে বিজেপি বিরোধী আক্রমণে নামতে দেখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Advertisement

বিজয়া দশমীর পর এ দিনই প্রথম তৃণমূলের নীতি কমিটির বৈঠক ডাকেন মমতা। বাংলায় ইদানীং বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার যে ধরনের মেরুকরণের রাজনীতিতে সক্রিয়, তাতে দলের নেতারা আগাম ধরে নিয়েছিলেন, গেরুয়া শক্তিকে মোকাবিলার পথ খোঁজাটাই মুখ্য হয়ে উঠতে পারে এই বৈঠকে। বাস্তবে হয়ও তাই। বৈঠক শুরু হতেই মোদী সরকার ও সঙ্ঘ পরিবারের ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। সেই সূত্র ধরেই বিজেপি-কে মোকাবিলার করার রণকৌশল দলের সামনে ফেলেন মমতা। বলেন, এ ব্যাপারে ত্রিমুখী কৌশল নিয়ে চলতে হবে। এক, বাংলায় বিজেপি কীভাবে বিভাজনের বিষ ছড়াচ্ছে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে তৃণমূলের তরফে কালীপুজোর আগেই একটা পুস্তিকা প্রকাশ করতে হবে। সুখেন্দুশেখর রায়, দীনেশ ত্রিবেদী-সহ দলের সাত জন নেতাকে নিয়ে ওই পুস্তিকা রচনার দায়িত্বে থাকবেন সৌগতবাবু। দুই, রাজ্যে আসন্ন উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি যাতে কোথাও অশান্তি-উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, সে জন্য আগামী ৩ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রত্যেক ব্লকে পথসভা করবেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এবং তিন, বাংলায় সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করতে বিজেপি-র প্ররোচনা ও কেন্দ্রের বঞ্চনার রাজনীতির বিরুদ্ধে ১৬ নভেম্বর সংসদের উভয় কক্ষে সরব হবেন দলের সাংসদরা।

সংসদীয় রাজনীতির কৌশলের প্রসঙ্গেই এ দিন কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত দলকে জানান তৃণমূলনেত্রী। দলীয় নেতাদের মমতা বলেন, কোনও একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে একক ভাবে বিজেপি-র মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। একা নীতীশ কুমার যেমন বিজেপি-র সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন না, তেমনই মুলায়ম-অখিলেশদের পক্ষেও তা একক ভাবে সম্ভব নয়। তাই সবকটা আঞ্চলিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে নিয়ে একটা ফ্রন্ট তৈরি করতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে কংগ্রেসকেও।

সূত্রের মতে, কংগ্রেস সম্পর্কে মমতার এই কথাটাই এ দিন সবথেকে বেশি কানে বাজে তৃণমূলের নেতাদের। পরে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, পরবর্তী লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস-তৃণমূল কাছাকাছি আসার ব্যাপারে সম্ভাবনা ছিলই। বাংলায় বিজেপি-র মেরুকরণের রাজনীতির তীব্রতাই উভয়ের কাছাকাছি আসার সময়টা আরও এগিয়ে দিচ্ছে।

স্বাভাবিক ভাবেই এতে খুশি কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য এ-ও বলেন, কেন্দ্রে মোদী সরকার গঠনের

পর থেকে মমতার কাছে এই রাজনীতিটারই প্রত্যাশা ছিল সনিয়া গাঁধীর। কিন্তু তৃণমূলনেত্রীই আশাহত করেছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রীকে। কারণ গত দু’বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে সংসদের ভিতরে ও বাইরে উল্টে বিজেপি-র সঙ্গে সমন্বয় করে চলছিল তৃণমূল। প্রাথমিক ভাবে তাতেই মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল উভয় শিবিরে। পরে বিধানসভা ভোটের সময় তিক্ততাও তৈরি হয়েছিল। তবে বাংলায় ভোট মিটতেই তা কমিয়ে আনতে চেষ্টা শুরু করে হাইকম্যান্ড। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সৌজন্যের রাজনীতি বজায় রাখাও শুরু হয়েছিল এআইসিসি-র তরফে। শেষে অভিষেকের দুর্ঘটনার খবর শুনে হাইকম্যান্ডের ফোনও আসে কালীঘাটে। কারণ, সনিয়া বুঝতে পারছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-কে কোণঠাসা করতে হলে মমতা-নীতীশদের সঙ্গে সম্মিলিত পদক্ষেপ করা ছাড়া পথ নেই।

তৃণমূলের তাগিদটাও জলের মতো স্বচ্ছ। দলের এক শীর্ষ সারির নেতার কথায়, আসলে বাংলার স্বার্থেই এখন জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী ফ্রন্ট গঠনে আগ্রহী দিদি। তৃণমূলনেত্রী বুঝতে পারছেন, বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারকে শুধু বাংলায় মোকাবিলা করলে চলবে না। জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি সফল হলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাতেও। এ রাজ্যে গেরুয়া বাহিনীর জনপ্রিয়তা ও দাপট তাতে আরও বাড়তে পারে। সেই কারণেই এ বার সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মোদী-অমিত শাহদের কোণঠাসা করতে চাইছেন মমতা। তাই নীতীশ-অখিলেশদের পাশাপাশি কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানোর কথাও বলছেন। কারণ, কংগ্রেস ছাড়া জাতীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষ জোট যে শক্তিশালী হতে পারবে না সেটা তারও জানা।

চুম্বকে ‘মেলালেন মোদীই মেলালেন’। ফের কাছাকাছি আসছে কংগ্রেস-তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement