মেদিনীপুরের সজিনাগাছিয়ার বৃদ্ধাশ্রমে এ ভাবেই দিন গুজরান করেন আবাসিকরা। (ইনসেটে) সদ্যপ্রয়াত অর্চনা সাহা।—নিজস্ব চিত্র।
ঘড়ির কাঁটা বেলা দু’টো ছুঁইছুঁই। টিনের ছাউনি দেওয়া একচালা ঘর। পাশে বারান্দায় মাদুরে চাদর বিছিয়ে শোওয়ার জায়গা। আধময়লা কাপড় পরে বসে বছর ৬৫-র এক বৃদ্ধা। একটি চোখ নষ্ট। আওয়াজ পেয়েই বললেন, ‘‘এত বেলা হল। কেউ খেতে দিল না এখনও!’’
বৃদ্ধার নাম অর্চনা সাহা। পূর্ব মেদিনীপুরের সজিনাগাছিয়ায় রায়চক গ্রামে ‘রায়চক মর্নিং স্টার ওল্ডএজ হোম’-এর আবাসিক ছিলেন। বিছানায় পায়খানা-প্রস্রাব করে ফেলছিলেন বলে তাঁকে হোমের নির্মীয়মাণ গোয়ালঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। আনন্দবাজার বিষয়টি সরেজমিন দেখে আসার দিন দুয়েকের মধ্যেই মারা গিয়েছেন অর্চনা। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, অর্চনার দেখভালেই যে শুধু গাফিলতি ছিল তা নয়, তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসাও করাননি হোম কর্তৃপক্ষ। হোমের তরফে সম্পাদক বিশ্বজিৎ মণ্ডলের দাবি, ‘‘অর্চনাদেবীর শারীরিক কষ্ট ছিল না। বিছানায় পায়খানা-প্রস্রাব করে ফেলতেন। তাই হাসপাতাল
ভর্তি নিতে চায়নি।’’
২৫ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার যখন ওই বৃদ্ধাশ্রমে যায়, তখন কিন্তু আবাসিকদের কেউই প্রায় হোমটি নিয়ে ভাল কথা বলেননি। তাঁদের কাছেই শোনা গেল, সকালে এবং রাতের খাবার মানে মুড়ি। রাতে যাঁরা মুড়ি খেতে পারেন না, তাঁদের দুপুরের ভাত জল ঢেলে রাখা থাকে। দু’দিনের বেশি মাছ জোটে না। অসুখবিসুখ হলে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারকে ডাকা হয়। বড় কিছু হলে গন্তব্য তমলুক সদর হাসপাতাল। কিন্তু অভিযোগ, হোম কর্তৃপক্ষের চেষ্টা থাকে কয়েক দিনের মধ্যেই রোগীকে নিয়ে চলে আসার।
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইন্টিগ্রেটেড প্রোগ্রাম ফর ওল্ডার পার্সনস’ প্রকল্পের অনুদানে এই হোমটি ১৯৮৯ সাল থেকে চালু রয়েছে। মোট ২৫ জন আবাসিকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা। যদিও বর্তমানে আছেন ১৬ জন। কিন্তু চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্রের থেকে ২৫ জনের জন্যই ৯ লক্ষ টাকা পেয়েছে হোমটি। সেই টাকায় কী দেওয়া হচ্ছে আবাসিকদের?
দোতলা বাড়ির লম্বা বারান্দায় জানালার পাশে পরপর তক্তপোশ পাতা। তক্তপোশ লাগোয়া জানলার গ্রিলে দড়ি টাঙানো। সেখানেই ঝুলছে জামাকাপড়। বাকি জিনিস ব্যাগে রেখে তক্তপোশের তলায় রাখার ব্যবস্থা। বারান্দার শেষে দেওয়াল তুলে আর টিনের দরজা বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি শৌচাগার। সেটি শুধু রাতেই ব্যবহার করা যায়। স্নান, কাপড়-কাচা, বাসনপত্র ধোয়া থেকে শুরু করে সবই সংলগ্ন পুকুরে সারতে হয় বলে অভিযোগ আবাসিকদের।
আরও অভিযোগ, পুজোর সময়ে আবাসিকদের জোর করে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুজোর সময়ে দশ দিনের জন্য অর্চনাকেও আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। নইলে আশ্রম ছাড়তে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, বলে অভিযোগ। অর্চনাদেবীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার কথায়, বছর খানেক আগে অর্চনা সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর উপযুক্ত দেখভাল হয়নি। হোম কর্তৃপক্ষের পাল্টা দাবি, এক বার তমলুক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল অর্চনাকে। তার পর স্থানীয় চিকিৎসককে দিয়ে হোমেই চিকিৎসা করানো হতো। কিন্তু হাসপাতাল সূত্রের খবর, স্ক্যান রিপোর্টে দেখা গিয়েছে মাস খানেক আগে তাঁর ফের সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল দু’টি কিডনি। হার্টেও সমস্যা ছিল। চিকিৎসকদের মতে, এত রকম অসুখ থাকলে যে নিয়ম ও পরিচর্যায় থাকতে হয়, তাতে না থাকার জন্যই সমস্যাগুলি বেড়ে গিয়েছিল।
হোমের দোতলায় তিনটি ঘর। একটি ঘরই আবাসিকদের। বাকি দু’টি ঘরের একটিতে থাকেন বৃদ্ধাশ্রমের জন্য গঠিত কমিটির দুই সম্পাদক পরিবারের লোকজন। দুই সম্পাদক-ভাই অক্ষয় এবং বিশ্বজিৎ মণ্ডলের কথায়, বাড়িটা তাঁদেরই। হোম করার জন্য ভাড়া দিয়েছেন! কেন্দ্রের ৯ লক্ষ টাকা পেতে অনেক অফিসারকে টাকা খাওয়াতে হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। তাই ভাল ব্যবস্থা করা যায়নি। রাজ্য শিশু ও সমাজ কল্যাণ দফতরের আধিকারিক অভিজিৎ মিত্রের কথায়, ‘‘কেন্দ্র সরাসরি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। মাঝে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি থাকে না।’’ তবে গত ছ’মাসে ওই হোমটিতে পরিদর্শন হয়নি, তা স্বীকার করেছেন জেলার সমাজকল্যাণ আধিকারিক ফুরশিদ আলম। বলেন, ‘‘পরিদর্শনে যেতে পারিনি। তদন্ত করাতেই হবে।’’