পুরসভা হলে পথবাতি বসত লোকালয়ে। ঘুচত আঁধার। —নিজস্ব চিত্র।
প্রস্তাবটা প্রথম উঠেছিল বছর বাইশ আগে। গত ১২-১৩ বছর ধরে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে সেই দাবি। কিন্তু আজও পুরসভার আওতায় এল না নাকাশিপাড়া। ‘বেথুয়াডহরি’র নামে প্রস্তাবিত ওই পুরসভার জন্য চিঠি চালাচালি হয়েছে বিস্তর। আঁকা হয়েছে মানচিত্র। লালফিতের ফাঁসে আটকে সে সব চেষ্টাই। সম্প্রতি অবশ্য জেলা প্রশাসন থেকে ফের এই সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। ব্লক প্রশাসন তথ্যাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে যথাসময়ে। ফাইলের পাহাড় ঠেলে উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হয়, সেদিকেই তাকিয়ে নাকাশিপাড়া।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নদিয়া রাজের অনুগ্রহে রাজস্থান থেকে সিংহরায় বংশের কয়েকজন এসে নাকাশিপাড়ায় জনপদের পত্তন ঘটান। সেই সময় নাকাশিপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গা। নাকাশিপাড়ার জমিদারদের দানের জমিতেই গড়ে ওঠে থানা, ব্লক প্রশাসনের কার্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খানিক দূরে বেথুয়াডহরিতে তৈরি হয় পিচের রাস্তা। কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ওই রাস্তার ধারেও গড়ে ওঠে জনবসতি। ধীরে ধীরে বেথুয়াডহরিকে ঘিরে বিস্তার হতে থাকে নাকাশিপাড়ার। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধার বরাবর সার দিয়ে গড়ে ওঠে দোকানপাট। নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত চক হাতিশালা, যুগপুর, কাঠালবেড়িয়া, জগদানন্দপুর, চিচুড়িয়া, খিদিরপুর, বেথুয়াডহরি প্রভৃতি মৌজায় জনঘনত্ব বাড়তে থাকে হু হু করে।
ব্যবসা-বানিজ্যে সমৃদ্ধ বেথুয়াডহরির হাসপাতাল পাড়া, স্টেশন পাড়া, নিচু বাজার, সাহা পাড়া, খিদিরপুর, জলট্যাঙ্ক পাড়া, ফুলতলা-হরিতলা, পাটুলি রোর্ড, মহাপ্রভু রোড প্রভৃতি জায়গায় এখন গায়ে-গায়ে বহুতল বাড়ি। সঙ্কীর্ণ রাস্তাঘাট, খোলা নর্দমা, রাস্তার উপরেই পড়ে থাকে আবর্জনার স্তুপ, ভারী বৃষ্টিতে জল জমে এলাকায়। পথবাতি নেই বলে চেনা পথঘাট অচেনা হয়ে ওঠে রাতে। শহরের ব্যস্ততম ও ভিড়ে ঠাসা পাটুলি রোডের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। সকাল-সন্ধ্যায় এই রাস্তার ধারেই অস্থায়ী দোকানে চলে কেনাবেচা। স্থানীয় বাসিন্দা সৌরভ সরকার বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতের পক্ষে রাস্তা-ঘাট ছিমছাম রাখা বা রাস্তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বাড়ানো সম্ভব নয়। পুরসভা হলে তবেই নাগরিকরা সব পরিষেবা ঠিক মতো পাবেন।’’
বাস্তবিকই পুরসভাগুলি কেন্দ্রের জওহরলাল নেহরু আরবান রিন্যুয়াল মিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে বিপুল অর্থ পায়। তার উপর রয়েছে করবাবদ রোজগার। জঞ্জাল সাফাই থেকে শুরু করে নর্দমা পরিষ্কারসব বিষয়েই পুর এলাকায় রয়েছে পৃথক কর্মী-বাহিনী। যা পঞ্চায়েতে নেই। বেথুয়াডহরি-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের সুজাতা বাছার সাফ বলছেন, ‘‘এলাকার মানুষের প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়ার মতো লোকবল বা অর্থবল কোনওটাই আমাদের নেই। এই অবস্থায় পুরসভা না হলে সমস্যার সমাধান হবে না।’’
পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৯২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতি সদর মহকুমাশাসকের কাছে পুরসভা গঠনের প্রস্তাব পাঠায়। ২০০১ সালে নাকাশিপাড়া বিধানসভা থেকে জয়ী হন তৃণমূলের কল্লোল খান। তিনি একাধিকবার বিধানসভায় বেথুয়াডহরিকে পুরসভা হিসেবে ঘোষণার পক্ষে যুক্তি সাজান। ২০০২ সালের ১২ মার্চ জেলাশাসক নাকাশিপাড়ার বিডিও-কে প্রস্তাবিত পুর এলাকার মৌজা ম্যাপ চেয়ে চিঠি দেন। ব্লক অফিস থেকে তথ্যাবলী সাজিয়ে জেলাশাসক রাজ্য পুর দফতরের সহ-সচিবকে চিঠি দেন। কিন্তু ব্লক থেকে জেলাশাসকের কার্যালয়, জেলা কার্যালয় থেকে তত্কালীন রয়টার্স পর্যন্ত চিঠিচাপাটিই সার। কাজের কাজ কিছু হয়নি। ২০০৫ সালে স্থানীয় বিধায়ক পুনরায় বিধানসভায় বিষয়টি তোলেন। ২০০৭ সালে জেলাশাসক জানান, বেথুয়াডহরি-১, ২ ও বিল্বগ্রামের পঞ্চায়েতর সদস্যদের পুরসভা গঠনের ব্যাপারে সায় আছে কিনা সে ব্যাপারে জানাতে হবে। সম্মতি নিতে হবে নাকাশিপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদেরও। সেই রিপোর্টও পাঠানো হয় জেলাশাসকের কাছে। কিন্তু বিস্তর চিঠি চালাচালির পরেও রাজ্যের পুর দফতর এই ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করেনি। বিধায়কের দাবি, ‘‘সমস্ত শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও বাম আমলে পুরসভা গঠনের দাবি মানা হয়নি।’’
বর্তমান তৃণমূলের সরকারের আমলেই বা কাজ কী হয়েছে?
মাস ছ’য়েক আগে নদিয়ার হরিণঘাটা পুরসভা হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। বেথুয়াডহরি সেই তিমিরে। নাকাশিপাড়ার বিডিও হেমন্ত ঘোষের অবশ্য দাবি, ‘‘জেলাশাসক প্রস্তাবিত পুর এলাকার ম্যাপ, জনসংখ্যা, জনঘনত্ব ও পঞ্চায়েতগুলির কর্মীরা প্রস্তাবিত পুরসভায় কাজ করতে চাইছেন কিনা সেই মর্মে রিপোর্ট চেয়েছিলেন। দিন কুড়ি আগে সেই রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।’’
স্থানীয় বিধায়ক কল্লোল খানের আশ্বাস, ‘‘সদ্য সমাপ্ত বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেথুয়াডহরি দ্রুত পুরসভা হবে।’’
এক দশকেরও বেশি এই হচ্ছে-হবে শুনতে-শুনতে ক্লান্ত নাকাশিপাড়া।