বর্ষার মুখে তড়িঘড়ি কাজ শুরুতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। নিজস্ব চিত্র।
পদ্মায় ভাঙন রোধের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফরাক্কা ব্যারাজের এক কর্মীকে প্রায় এক ঘণ্টা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখলেন কংগ্রেসের বেশ কিছু সমর্থক ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের একাংশ। রবিবার জঙ্গিপুরের মিঠিপুর এলাকার ঘটনা। পরে শান্তিকুমার দাস নামে ওই কর্মী কাজ বন্ধ রাখার আশ্বাস দিয়ে রেহাই পান। এই ঘটনার পর শান্তিবাবু অবশ্য কোথাও কোনও অভিযোগ জানাননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “ভাঙন রোধের কাজের জায়গায় নজরদারি চালাতে গিয়ে এই ধরণের হেনস্থা নতুন কিছু নয়। ওঁরা কাজ বন্ধ করতে বলেছিলেন। কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এভাবে গাছের সঙ্গে আমাকে না বেঁধে মুখে বললেই পারতেন। তাছাড়া বর্ষায় কাজ করা না করা, কাজের সিডিউল দেখানোর মতো বিষয়গুলো আমার এক্তিয়ারে পড়ে না। তাই আমাকে হেনস্থা করার আগে ওঁরা ব্যারাজের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে বললেই পারতেন।” ব্যারাজের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ফাগুরাম সর্দার বলেন, ‘‘গত ৪০ দিন থেকে সেখানে তো শান্তিতেই কাজ হচ্ছিল। হঠাৎ রবিবার ওই কর্মীকে এভাবে হেনস্থা করে কাজ বন্ধ করা হল কেন বুঝতে পারছি না। চার মাসের মধ্যে মিঠিপুরের কাজ শেষ করতে হবে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে দেখছি তাঁরা কী চান।
ব্যারাজ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ৪০০ মিটার এলাকা জুড়ে মিঠিপুরে ভাঙন রোধের প্রায় ৪ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে গত ১০ মে থেকে। অভিযোগ, এই দেড় মাসে ১০ শতাংশ কাজও এগোয়নি। প্রতি বছর বর্ষার সময় কাজ শুরু করায় সরকারের সমস্ত অর্থই জলে যাচ্ছে। রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লক কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সমিরুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘‘১ মাস ১০ দিন ধরে কাজ চলছে মিঠিপুরে। অথচ কাজ এক কদমও এগোয়নি। দু’দিন থেকে বৃষ্টি শুরু হতেই যেটুকু কাজ হয়েছিল তার দু’জায়গাই বসে গিয়েছে। বৃষ্টিতে পদ্মার জল বাড়ছে। বারবার দাবি করা হয়েছে, বর্ষার সময় গঙ্গা ও পদ্মায় ভাঙন রোধের কোনও কাজ করা যাবে না। এতে কাজের থেকে দুর্নীতি হয় বেশি। তবুও এই বৃষ্টির মধ্যেই দু’দিন থেকে দু’শোরও বেশি মজুর নামিয়ে ভাঙন রোধের কাজে জোর দিয়েছে ঠিকাদার ও ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ। এর পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে।” সমিরুদ্দিন বলেন, “বৃষ্টির মধ্যেই কাজ চলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে দিয়ে দেখি ২০০ মজুরকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজের জায়গায় ব্যারাজের কোনও ইঞ্জিনিয়ার নেই। এক জন মাত্র কর্মী কাজ দেখছেন। চার কোটি টাকার কাজ হচ্ছে অথচ কোথাও কোনও বোর্ড টাঙানো নেই। কাজের সিডিউল চাইলে ওই কর্মী দিতে চাননি। নদীর ভাঙন যেখানে আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। অথচ বর্ষার মধ্যে সেই কাজ নিয়ে ছেলে খেলা হচ্ছে।”
এরপরেই ক্ষুব্ধ কংগ্রেস সমর্থকরা ভাঙনের কাজের নজরদারিতে থাকা ফরাক্কা ব্যারাজের কর্মী শান্তিকুমার দাসকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। মিঠিপুরের বাসিন্দা মনোরঞ্জন সরকার বলেন, ‘‘দু’বছর আগেও এই ভাবে বর্ষার সময় মিঠিপুরেই এই জায়গাতেই ভাঙন রোধের কাজ করেছিল ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ। তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। আবার সেই জায়গাতেই কাজ হচ্ছে। বর্ষার সময় অন্য জায়গায় ভাঙন রোধে কাজ হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ কিলোগ্রাম ওজনের পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে। আর মিঠিপুরে ২ থেকে ১০ কিলোগ্রাম ওজনের পাথর ফেলে কাজ করা হচ্ছে। পদ্মায় জলের তোড়ে তা টিকবে না।” স্থানীয় বাসিন্দা সেলিম শেখ বলছেন, “কেন্দ্রীয় সরকার মিঠিপুরকে বাঁচাতে আগে একবার টাকা বরাদ্দ করেছে। এবার আবার ৪ কোটি টাকা দিয়েছে। তাই এবার আমরা কাজ বুঝে নেব। কাজ দু’দিন পরে হোক, অসুবিধে নেই। কিন্তু বর্ষার সময় জলে পাথর ফেলে কোটি টাকার দুর্নীতি করতে দেব না। কিভাবে কাজ করা হবে তা সবিস্তারে লিখে পদ্মাপাড়ে বোর্ড টাঙাতে হবে। সমস্ত কাজে নজরদারি চালাবে গ্রামের মানুষ।” স্থানীয় বিধায়ক কংগ্রেসের আখরুজ্জামান বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের দাবিতে কোনও অন্যায় নেই। ভাঙনে তো তাঁদেরই সর্বস্বান্ত হতে হয়। বর্ষাকালে ভাঙনের কাজ হলে পুরো টাকাটাই জলে যায়। কম পাথর ফেলে অনেক বেশি পাথর দেখানো হয়। ঠিকাদার ও সরকারি অফিসারদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে দুর্নীতি চলে। নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই গ্রামবাসীরা সেই দুর্নীতি বন্ধ করতে চেয়েছেন। গ্রামবাসীদের দাবি মেনে স্পেশাল অফিসার বসিয়ে মিঠিপুরে পদ্মা ভাঙনের কাজ করতে হবে। তা না হলে সেখানে কাজ বন্ধ থাকবে।” স্থানীয় বাসিন্দা তথা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সোমনাথ সিংহ রায় বলেন, ‘‘ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ এতদিন এই এলাকায় ভাঙন রোধের যা কাজ করেছে কোনও ক্ষেত্রেই কাজের সিডিউল প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয় মানুষ সে সব জানতে পারে না বলে দুর্নীতিও ধরতে পারে না। এর আগেও ভাঙন রোধের যে কাজ হয়েছে তার বেশির ভাগই দু’এক বছর পরেই ধসে গিয়েছে।”
তবে জঙ্গিপুরের কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় অবশ্য ব্যারাজের ওই কর্মীর হেনস্থার ঘটনাকে সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, “ওই সরকারি কর্মীকে এভাবে বেঁধে রাখা ঠিক হয়নি। ভাঙনের কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে তা লিখিত ভাবে উপযুক্ত জায়গায় জানানো যেত। তা না করে এভাবে হেনস্থার ঘটনা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”