সচেতনতা বাড়াতে মৎস্য দফতরের প্রচার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
মৎস্যজীবীদের সচেতন করতে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে জোরকদমে প্রচার চলছে। উদ্দেশ্যইলিশ মাছ সংরক্ষণ। ওই উপলক্ষে গত ২৪ জুন থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে জোরকদমে প্রচার চালানো হচ্ছে। আগামী ২৭ জুন পর্যন্ত ওই প্রচার চলবে। প্রচারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বিশেষ করে ফরাক্কা থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত ভাগীরথীর অববাহিকা বরাবর মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন ব্লক। মুর্শিদাবাদ জেলা মৎস্য দফতরের সহ-অধিকর্তা মলয়কুমার সাহু বলেন, “মৎস্যজীবীদের জাল থেকে ২৩ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চির ছোট খোকা ইলিশ রক্ষা করে অবলুপ্তির হাত থেকে ইলিশকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ওই প্রচার চলছে।”
তবে এই প্রথম নয়। বর্ষা মরসুম শুরুর আগেই ২০১৩ সালে জেলা মৎস্য দফতর এক দিনের প্রচার চালিয়েছিল। তাতে মৎস্যজীবীরা সচেতন হয়ে খোকা ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এ বার চার দিন ধরে ওই প্রচার চালানোর ফলে ওই সচেতনতা বাড়বে বলেই অনুমান জেলা মৎস্য দফতরের।
তবে নিছকই প্রচারের মধ্যে দিয়ে খোকা ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে মৎস্যজীবীদের মধ্যে কতটুকু সচেতনতা আসবে, তা নিয়ে আশঙ্কাও রয়েছে গবেষক মহলে।
মৎসজীবীদের নিয়ে গত দু’দশক ধরে গবেষণা করছেন কান্দির জেমো এনএন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা গবেষক সূর্যেন্দু দে। তাঁর কথায়, “১৯২৭, ১৯৫৯, ও ১৯৭২-৭৪ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রাণীদের সংরক্ষণের উপরে গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি হয়েছে। যেমন ব্যাঘ্র প্রকল্প, কুমীর প্রকল্প, কচ্ছপ প্রকল্প। এই ধরনের কোনও প্রকল্প ইলিশ মাছের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি। এটাই আশ্চর্যের!”
ইলিশ প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন সরকারি দফতরের আধিকারিকদের কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের ওই গবেষক-শিক্ষক। তাঁর আক্ষেপ, “কিন্তু রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউ এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও
পদক্ষেপ করেনি।”
এ দিকে গত কয়েক বছর ধরে চলছে নির্বিচারে খোকা ইলিশ নিধন। এখনও সচেতন হতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইলিশ ‘গল্প-কথায়’ রয়ে যাবে বলেই সূর্যেন্দুবাবু মনে করেন। তিনি বলেন, “১৮৯৭ সালের ইন্ডিয়ান ফিসারিজ অ্যাক্ট (iv), ১৮৮২ সালের বেঙ্গল অ্যাক্ট ও ১৯২৭ সালের ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট (xvi)-এ স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছেইলিশ মাছেদের মুক্ত বিচরণের জন্য কোনও বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।” তিনি জানান, জাল ফেলার পরেও ইলিশের অবাধ যাতায়াতের জন্য কমপক্ষে তিন ফুট ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে এবং ৯ ইঞ্চি বা তার ছোট আকারের ইলিশ ধরা না পড়ে তেমন ভাবে মৎস্যজীবীদের জালের ফাঁক সুনিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়াও ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ অন্তর্দেশীয় মৎস্য বিধি অনুযায়ী ইলিশ মাছ সংরক্ষণে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণ বলতে ওই আইনে ইলিশের সুষ্ঠু ও অবাধ প্রজননের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ভাগীরথীতে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথাও জেলা মৎস্য দফতরের প্রচারে রয়েছে। ভগবানগোলা-২ মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ আধিকারিক সঞ্জয় কুমার মিশ্র বলেন, “মৎস্যজীবীদের বুঝতে সুবিধে হবে বলে কোজাগরী পূর্ণিমার কথা উল্লেখ করে তার পাঁচ দিন আগে এবং পাঁচ দিন পরে ইলিশ না ধরার জন্য প্রচার করা হচ্ছে। তখন ইলিশের প্রজননের আদর্শ সময়।”
কেন্দ্রীয় সরকার ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু কোনও নজরদারি না থাকায় ওই নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত খাতায়-কলমে থেকে যায়। ওই নিষেধাজ্ঞা পালনের জন্য সরকারি তরফে কোনও আন্তরিকতা-উদ্যম দেখা যায় না বলেও ক্ষোভ রয়েছে ইলিশ প্রেমীদের।
সূর্যেন্দুবাবু বলেন, “দুর্গাপুজোর দশমীর দিন থেকে সরস্বতী পুজোর দিন পর্যন্ত ইলিশ না খাওয়ার রীতি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। ওই সময়ে নদীতে ইলিশ ডিম পাড়তে আসে। তখন যদি কেউ না খায়, তাহলে চারা বা খোকা ইলিশ ধরার ক্ষেত্রেও মৎস্যজীবীদের আগ্রহ থাকবে না। ফলে ইলিশ সংরক্ষণ হয়ে যাবে।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারকচন্দ্র দাস ‘কালচারাল সিগনিফিক্যান্স অফ ফিস্’ নামক প্রবন্ধেও ওই কথার উল্লেখ রয়েছে বলে তিনি জানান। তাঁর কথায়, “তবে দেখা গিয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ এই রীতি পালন করলেও এই বাংলায় কোনও দিনই তার চল ছিল না!”