১০ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব তিলিপাড়া লেন। নর্দমার ধার ঘেঁষা এক চিলতে সিমেন্টের বারান্দায় ভাতের থালা নিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন রোগাটে চেহারার এক যুবক। ‘ভাতের থালায় চোখের জল ফেলতে নেই’ বলে যুবককে নানা ভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন রাধা দাস আর শিবানী সরকার। কিন্তু তাতে কান্না থামে কই? একটু দূরে পিঙ্কি পণ্ডিত, আলেয়া বিবিরা ঘুরে ঘুরে টাকা সংগ্রহ করছিলেন ওই যুবকের জন্য। দশ বিশ যার কাছে যেমন পাওয়া যায়। কিন্তু কেন? ওঁরা বলছিলেন, “একটা মানুষ বিপদে পড়েছে। পারলে কিছু দিয়ে সাহায্য কর। নয়তো রাস্তা দেখ বাপু। এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় নেই।” কেউ দিচ্ছিলেন, কেউ আবার নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে নবদ্বীপের তিলিপাড়া লেনের যৌনকর্মীরা এ ভাবেই মায়ের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে আসা এক যুবককে ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ওই যৌনকর্মীদের স্থানীয় অভিভাবক ইন্দিরা সাহা বলেন, “এ দিন সকালে আসলাম শেখ নামে শিলিগুড়ির ভক্তিনগরের এক যুবক এখানে আসে এবং কিছু খেতে চায়। তার সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পারি সে বাড়ি থেকে চলে এসেছে। কিন্তু ওর কাছে যা ছিল তা সবই কেড়ে নিয়েছে কেউ। এরপর আমাদের মেয়েরাই ওই যুবকের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দেয়।” আসলাম বলছেন, “সৎ মায়ের গঞ্জনা, গালিগালাজ তবু সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িভর্তি লোকজনের সামনে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মামা চড় মারতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে দিকে দু’চোখ যায় বেড়িয়ে যাব, কিন্তু এ বাড়িতে আর নয়।” দিন তিনেক আগে রাতেই শিলিগুড়ির ভক্তিনগরের বাড়ি ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েন ২৮ বছরের যুবক আসলাম। সম্বল বলতে নগদ পাঁচ হাজার ভারতীয় টাকা, সাতশো নেপালি টাকা, একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র এবং অনেক স্মৃতি জড়ানো একটি পারিবারিক ছবির অ্যালবাম। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে কলকাতাগামী বাসে উঠে পড়েন ওই যুবক। সোমবার সকালে কৃষ্ণনগরে বাস থামতে তিনিও নেমে পড়েন। স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে আসলামের আলাপ হয়। আসলামকে দেখে শিকার চিনতে দেরি হয়নি ওই যুবকের। আসলামকে এক জায়গায় বসিয়ে নিজে হাতে আসলামের জন্য নিয়ে আসে গরম কচুরি। রাতভর বাসযাত্রা শেষে নতুন বন্ধুর হাতের খাবার পেটে পড়তেই চোখ জুড়ে নেমে আসে গাঢ় ঘুম। আসলাম জানান, ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তিনি কিছু বুঝতে পারেননি। তারপর একটু ধাতস্থ হতে তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর টাকাপয়সা, ঘড়ি, এটিএম কার্ড সব খোয়া গিয়েছে। সব শুনে স্থানীয় লোকজন আসলামকে পরামর্শ দেন নবদ্বীপ যেতে। তাঁরা আসলামকে জানান, নবদ্বীপ থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস-ট্রেন সব পাওয়া যাবে। ওই রাতেই তাঁরা নবদ্বীপগামী এক বাসে তাঁকে তুলে দেন তাঁরা। আসলাম বলেন, “সেই বাস আমাকে নবদ্বীপধাম স্টেশনের কাছে নামিয়ে দেয়। তখন বেশ রাত। অরপরিচিত এলাকায় নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। একজন রিক্সাচালক সব শুনে আমাকে থানা থেকে একটু দূরে একটি মোড়ের মাথায় নামিয়ে উনি আমাকে থানার রাস্তাও বলে দেন। কিন্তু আমি রাস্তা হারিয়ে এখানে চলে আসি।” তারপরেই ম্লান হেসে আসলাম বলছেন, “ভাগ্যিস এখানে এসে পড়েছিলাম। নবদ্বীপে এসে এই দিদিদের না পেলে কী করতাম জানিনা। হয়তো চরম কোনও সিদ্ধান্ত নিতাম। এই দিদিরাই আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।” মঙ্গলবার সারাদিন ধরে আসলামকে ওই যৌনপল্লির সকলেই অনেক বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। আসলাম বলেন , “দশ বছর আগে আমার মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন। মাধ্যমিকের পরে আর পড়তে দেয়নি আমায়। নকশালবাড়ির বিধাননগরে আমাদের চা বাগান এবং আনারস বাগান আছে। সৎ মা এবং মামা আমাকে পছন্দ করেন না। সব মেনে নিয়েই বাগান দেখাশোনা করতাম। ইদানিং সকলেই আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এ দিকেরও যা অভিজ্ঞতা হল! ভেবে দেখলাম এই দিদিরাই ঠিক বলছেন। শিলিগুড়ি ফিরে গিয়ে ঠিক অন্য একটা কাজ জুটিয়ে নেব। তারপর নিজের মতো করে বাঁচব। মাথা উচু করে।”
এ দিন আসলামের হাতে প্রায় এক হাজার টাকা তুলে দেন ওই যৌনকর্মীরা। দুপুর পেরিয়ে আসলাম যখন ফেরার পথ ধরছে, পূর্ব তিলিপাড়া লেনের মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলো সমস্বরে বললেন, “ঘর কি জিনিস তা কেবল সেই বোঝে যে একবার ঘর ছেড়েছে। ঘরের উপর রাগ করতে নেই রে।”