মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের ব্লক সভাপতির পদ এখন যেন ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’!
গত ২০১৪ সালের ১১ জুলাই বহরমপুরের সিরাজবাগে তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীল সেন যে কমিটি ঘোষণা করেন, তাতে বেলডাঙা ২ (পশ্চিম) ব্লক তৃণমূল সভাপতি পদ থেকে বামদেব দত্তকে সরিয়ে ওই পদে নিজের পছন্দের হেমন্ত ঠাকুরের নাম তালিকাভূক্ত করেন। পরে গত ১৮ অক্টোবর মান্নান হোসেন তৃণমূলের নতুন জেলা সভাপতি হওয়ার পরেই হেমম্ত ঠাকুরকে সরিয়ে ওই পদে ফের বামদেব দত্তকে বসানো হয়।
গত রবিবার বহরমপুরে ঋত্বিক সদনের ঠিক উল্টো দিকে সরকারি জায়গায় অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে জেলার বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করে তাঁদের রাজ্য নেতৃত্বের অনুমোদনের যে চিঠিও ধরানো হয়, তাতে ফের বাদ পড়ে গেলেন বামদেব দত্ত। ওই পদে বেছে নেওয়া হয়েছে সেই হেমন্ত ঠাকুরকেই। আর এই ঘটনার জেরে রেজিনগর বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের ‘অন্তর্কলহ’ ফের প্রকাশ্যে এসে পড়ল।
সেই সঙ্গে নতুন যে কমিটির অনুমোদন দিয়েছে রাজ্য নেতৃত্ব, তাতে দেখা গিয়েছে ডোমকল, জলঙ্গি, ফরাক্কা ও নবগ্রাম ব্লক সভাপতিদের সরানো হয়েছে। এ নিয়েও তৃণমূলের অন্দরে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ডোমকলের আলি আকসারের জায়গায় আবদুস সাত্তার মণ্ডল এবং জলঙ্গি ব্লক তৃণমূল সভাপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে যুগ্ম ব্লক সভাপতি হিসেবে মুস্তাক আহমেদ ও তহিরুদ্দিন শেখকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেন বলেন, “জলঙ্গি ব্লকে ১০টি অঞ্চল রয়েছে। ওই ১০টি অঞ্চলকে ভাগ করে ওই দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।” মান্নান বলেন, “জেলার সর্বত্র যখন সিপিএম-কংগ্রেস ছেড়ে দলে দলে মানুষ তৃণমূলে যোগ দিচ্ছে। তখন জলঙ্গি ও ডোমকল ব্লকে ভিন্ন চিত্র। ফলে নেতৃত্বের কোথাও ত্রুটি রয়েছে। ওই দুটি ব্লকে তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য নিয়েই ওই বদল করা হয়েছে।”
কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী করতে যে দু’জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তহিরুদ্দিন শেখ বিভিন্ন ‘অসামাজিক’ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া জলঙ্গি ব্লক তৃণমূল সভাপতি আবদুস সাত্তার অভিযোগ করেন। তাঁর অভিযোগ, “তহিরুদ্দিন সীমান্তে কাশির ওষুধ ও গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত। কোনও দিন তৃণমূল দল করেননি। পাচারের টাকা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে জলঙ্গি ছেড়ে এখন বহরমপুরে বাড়ি করে থাকেন। বহরমপুর থেকে যাতায়াত করে জলঙ্গি ব্লকে তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী হবে তো?” তাঁর সংযোজন, “আসলে যাঁরা সিন্ডিকেট করবেন, যাঁরা নেশার দ্রব্য পাচার করবেন, তাঁরাই এখন তৃণমূলের কাছের লোক হবে।”
ব্লক তৃণমূল পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেই রবিবার সন্ধ্যায় অনুগামীদের নিয়ে আবদুস সাত্তার স্থানীয় জলঙ্গি বালিকা বিদ্যালয় মাঠে সভাও করেন। ওই সভায় কয়েকশো অনুগামীর ভিড় করেন বলে আবদুস সাত্তারের দাবি। তাঁকে ব্লক সভাপতি পদ থেকে ছেঁটে ফেলার জন্য মান্নান-পুত্র সৌমিক হোসেনকে দায়ী করেন ওই প্রাক্তন ব্লক সভাপতি। তাঁর কথায়, “তৃণমূল জেলা সভাপতির ছেলে সৌমিক হোসেন তাঁর একজন কাছের ছেলেকে রাস্তার কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য জলঙ্গির বিডিও-কে অনুরোধ করার কথা বলেন। কিন্তু যাঁর জন্য আমাকে বলা হয়েছিল, তিনি অনৈতিক ভাবে ভুয়ো ক্রেডেনসিয়াল জমা দেয় বলে জানতে পারি। ফলে আমি ওই ধরনের কোনও অন্যায় কাজ করতে পারব না বলে সৌমিক হোসেনকে সাফ জানিয়ে দিই। সেই রাগে থেকেই আমাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।” এমন অভিযোগ অস্বীকার করে সৌমিক হোসেন অবশ্য পাল্টা বলেন, “আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে ফেনসিডিল পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দল তাঁকে ব্লক সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
এর আগে বহরমপুরের সিরাজবাগের আলোচনা কক্ষে মুর্শিদাবাদের জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক হিসেবে ইন্দ্রনীল সেন জেলার যে বিভিন্ন কমিটি গঠন করেন, রাজ্য নেতৃত্ব সেই কমিটির অনুমোদন দেয়। রবিবাসরীয় ছুটির দুপুরে রাজ্য নেতৃত্বের ওই অনুমোদনের চিঠি ধরানো হয় বিভিন্ন কমিটিতে থাকা পদাধিকারীদের। তবে সদ্য দল থেকে ছ’বছরের জন্য হুমায়ুন কবীরকে বহিষ্কারের পরে তাঁর অনুগামী বামাপদ দত্তকে সরে যাওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবীর বলেন, “মান্নান হোসেনকে শিখণ্ডী হিসেবে জেলা সভাপতি করে বসিয়ে রেখে বিভিন্ন কমিটিতে নিজের ‘ইয়েস ম্যানদের’ ঠাঁই দিয়েছেন ইন্দ্রনীল সেন। যাতে কলকাতায় বসে থেকে সহজেই তোলা আদায় করা সম্ভব হয়। তোলা আদায়কারীদের সামনের সারিতে তুলে আনতে গিয়ে পিছনের সারিতে তৃণমূল দলটাকে ঠেলে দিচ্ছেন ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীল সেন যত দিন ছড়ি ঘোরাবেন, তত দিন এই জেলায় তৃণমূলের সম্ভাবনা নেই।”
ওই মঞ্চ থেকে ফোনে ইন্দ্রনীল সেনকে ধরেন জেলা তৃণমূলের এক নেতা। উপস্থিত বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের সামনে ফোনে ইন্দ্রনীলবাবু ‘জেলায় আর এক জন হুমায়ুন কবীর যাতে তৈরী না হয় সেদিকে নজর রেখে দল পরিচালনা করার’ পরামর্শ দেন। তার পরেই হুমায়ুন ঘনিষ্ঠ বামাপদ দত্তকে ব্লক তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে সরানোর কথা ঘোষণা হয়।
তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল বলেন, “এ দিন ইন্দ্রনীল সেন ফোনে জানান, মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন পর্যবেক্ষক হিসেবে শুভেন্দু অধিকারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে জেলার পর্যবেক্ষক হিসেবে ইন্দ্রনীল সেনের পাশাপাশি শুভেন্দু অধিকারীও সংগঠনের বিভিন্ন দিকে নজর দেবেন।” উজ্জ্বলবাবু বলেন, “সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা কমিটিতে দুজন বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে সুব্রত সাহা ও সৌমিক হোসেন জায়গা পেয়েছেন।” তবে জেলা সম্পাদক পদ থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাদ গিয়েছেন সাহিত্যপ্রদীপ সিংহ ও শেখ আলহামদো ওরফে সায়েম। জেলা কমিটিতে ঠাঁই হয়নি উত্পল পালেরও।