মাত্র চার দিন আগেই নবদ্বীপের পাশাপাশি দু’টি মন্দিরে চুরি হয়েছে। একটি মন্দির থেকে দুষ্কৃতীরা নিয়ে গিয়েছে বিগ্রহ। অন্যটি থেকে বিগ্রহের অলঙ্কার। তারপরে প্রাচীন এই শহরের মন্দিরগুলির নিরাপত্তা কী করে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা তুলেছেন মঠ-মন্দিরগুলির কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। কিন্তু তার মধ্যেই আরও একবার বিগ্রহের অলঙ্কার চুরি হয়ে গেল সমাজবাড়ি থেকে। শহরের একটি মঠের এক অধ্যক্ষের কথায়, “মাত্র চার দিনের মধ্যেই ফের বড় একটি মঠে হানা দিল দুষ্কৃতীরা। অর্থাৎ, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মহিলাদের পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে চুরিতে।” এই আশঙ্কা অন্য মঠ-মন্দিরগুলির কর্তৃপক্ষেরও। পুলিশ জানিয়েছে, সমাজবাড়িতে যে ভাবে চুরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে দুষ্কৃতীরা নিখুঁত পরিকল্পনা করেই এসেছিল। নবদ্বীপ থানার আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “যে ভাবে চুরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে মন্দিরের পরিচিত কেউ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যেখানে সিংহাসন পড়েছিল, সেখান থেকে পাওয়া গিয়েছে মহিলার দু’জোড়া জুতো। আমরা সব দিক খতিয়ে তদন্ত শুরু করছি।”
তবে মাত্র চার দিনের মাথাতেই মোট তিনটি জায়গায় এ ভাবে দুষ্কৃতী হানা থেকে পরিষ্কার, নিরাপত্তা নিয়ে যতই আলোচনা হোক, দেবালয়গুলির আপাত ভাবে সুরক্ষার যথাযথ বন্দোবস্ত নেই। বিভিন্ন মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গত কয়েক মাসে একাধিক মঠ-মন্দিরে ছোটখাট চুরি হয়েছে। তবে সে সব সম্পর্কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হয়নি। এখন বড় চুরির পরে নড়েচড়ে বসেছেন সনাতন সন্ত সমাজ ও বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের কর্তৃপক্ষ। মন্দির কর্তৃপক্ষের কেউ তাই ভাবছেন ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানোর কথা। কেউ মাইনে করা রাত পাহারাদার রাখার খরচ হিসাব করছেন। কিন্তু সে সব করার সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁরা জোর দিচ্ছেন পুলিশি টহলদারির পাশাপাশি স্থানীয় ভাবে নৈশরক্ষী বাহিনী চালু করার দিকে। গঙ্গার তীরবর্তী মঠমন্দির কর্তৃপক্ষ চাইছেন জলপথে টহলদারির ব্যবস্থা করুক পুলিশ প্রশাসন।
প্রাচীন শহর নবদ্বীপের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে ছোটবড় দেড় শতাধিক মঠ-মন্দির। এদের মধ্যে কয়েকটি সব দিক থেকেই বিশাল। বাকিগুলি মাঝারি বা একেবারেই ছোট। কিন্তু এ সব মঠ-মন্দির রয়েছে বহু প্রাচীন বিগ্রহ, পুথি, গ্রন্থ বা অন্য কোনও বহুমূল্য জিনিসপত্র। পাশাপাশি নবদ্বীপে এমন কোনও দেবালয় খুঁজে পাওয়া ভার, যেখানে কখনও চুরি হয়নি। বিষ্ণুপ্রিয়া সেবিত মহাপ্রভু মন্দিরের ধাতব বিগ্রহ, ভবতারিণী মন্দিরের অলংকার, বুড়োশিব মন্দিরের পাথরের দুর্গা, হংসবাহন শিব, পালচৌধুরী বাড়ির রাধাকৃষ্ণ, সুপ্রাচীন মঙ্গলচন্ডী মূর্তির মতো দুষ্প্রাপ্য মূর্তি চুরির পাশাপাশি অসংখ্য ছোটবড় চুরির ঘটনা রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব চুরির কোনও কিনারা হয়নি।
নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “যারা গঙ্গার কাছাকাছি থাকি, তাদেরই ভয় সব থেকে বেশি। নবদ্বীপের উত্তর এবং পূর্ব দিক বরাবর গঙ্গা। নৌকা করে এসে কাজ সেরে দুষ্কৃতীরা সহজেই অন্যত্র পালিয়ে যেতে পারে। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন রাখছি, জলপথে প্রহরার ব্যবস্থা করুন।” নবদ্বীপের প্রাচীন হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রক্ষ্মচারীর বক্তব্য, বিভিন্ন পাড়ায় আগের মতো নৈশরক্ষী বাহিনী চালু করা গেলে ভাল হয়।” বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সম্পাদক লক্ষীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “একবার চুরির পরে আমরা মন্দিরে রাতে মোট তিন জন মাইনে করা পাহারাদার রাখতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু নবদ্বীপের মতো শহরে পুলিশের একটা প্রধান দায়িত্ব মঠমন্দিরের নিরাপত্তা। সিসিটিভি-র কথাও ভাবতে হবে।” নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের কার্যকরী সভাপতি ভাগবতকিশোর গোস্বামী বলেন, “নবদ্বীপের বেশির ভাগ মঠমন্দিরের কর্তৃপক্ষ ভয়ে দেবতাকে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে রাখেন। কেবল উঃসবের সময় পুলিশ প্রহরায় আসল অলঙ্কার দেবতাকে পরানো হয়। বাকি সময় ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে বাধ্য হন।” তাঁর কথায়, “সিসিটিভি বসাতেই হবে।”
এ বিষয়ে নদিয়ার এসপি সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, “নবদ্বীপের আইসিকে বলা হয়েছে নৈশরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে কীভাবে রাতে মঠ মন্দিরের নিরাপত্তা বাড়ানো যায়, তা দেখতে। জলপথে সুরক্ষার জন্য রিভারব্যাঙ্ক আরজি পার্টি গড়া যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে।”