প্রায় দেড় মাস পরে, নবদ্বীপের অতিরিক্ত এবং সেশন জজ সুধীর কুমারের আদালতে সজল ঘোষ হত্যা মামলার শেষ পর্বের শুনানি শুরু হল সোমবার। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। এ দিন থেকে শুরু হল আইনজীবীদের সওয়াল।
এ দিন আদালত চত্বরে পূর্বস্থলী কলেজের টিএমসিপি সমর্থকেরা ব্যানার নিয়ে, অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে পৌঁছে যায়। ভিড়ে ঠাসা আদালত কক্ষে দুপুর দুটোয় শুরু হয় মামলার শুনানি। তার আগে কালো প্যান্ট, ডোরাকাটা জামায় অন্যতম অভিযুক্ত, পূর্বস্থলীর সিপিএম নেতা তথা পারুলিয়া কুলকামিনী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ সাহাকে বাকি পাঁচজন অভিযুক্তের সঙ্গে কাঠগড়ায় হাজির করানো হয়।
সরকারি পক্ষের আইনজীবী বিকাশবাবু এ দিন প্রায় দু’ঘণ্টা একাই সওয়াল করেন। শুরুতেই সংক্ষেপে মামলার প্রেক্ষাপট জানান তিনি। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি পূর্বস্থলী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়ে এসএফআই ও টিএমসিপির গোলমাল বাধে। তিনজন ছাত্র আহত হয়ে নবদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি হন। রাতে পূর্বস্থলী উত্তরের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতা-কর্মী নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। নীচে নামার সময়ে হাসপাতাল চত্বরেই খুন হয়ে যান সজল ঘোষ। মামলার এক নম্বর সাক্ষী পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়ের দায়ের করা এফআইআর অনুযায়ী, সেই রাতে প্রদীপ সাহা মোটরবাইকে লোকনাথ দেবনাথ এবং লাল হেলমেট মাথায় একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। সজল ঘোষকে দেখে তিনি বলেন, ‘একে না সরাতে পারলে পূর্বস্থলী কলেজে ভোট করা যাবে না।’ এরপরেই সজল ঘোষকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। অভিযোগ, লোকনাথ দেবনাথ তার চাদরের ভিতর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে সজল ঘোষকে গুলি করে।
পাঁচ প্রত্যক্ষদর্শী-সহ মোট কুড়িজনের সাক্ষ্য, তাঁদের জবানবন্দি, জেরা ইত্যাদির ভিত্তিতে কয়েকটি বিষয়ে এ দিন আদালতের নজর কাড়তে চান বিকাশবাবু। তাঁর প্রথম যুক্তি, অভিযুক্ত প্রদীপ সাহার আইনজীবীরা বারবার বলেছেন তিনি সমাজসেবী। এলাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু এ সব বলে তাঁরা সহানুভূতি কুড়োতে চাইছেন বলে বিকাশবাবুর দাবি। তিনি জানান, রাজনৈতিক শত্রুতার অভিযোগও ধোপে টেঁকে না। কারণ সে সময় সবে তপন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের হয়ে প্রদীপবাবুকে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছেন। পাঁচ বছরের জন্য তপনবাবু নিশ্চিন্ত। যদি প্রদীপবাবুর জন্য তপনবাবু হেরে যেতেন তাহলে না হয় শত্রুতার যুক্তি মানা যেত।
তাঁর দ্বিতীয় যুক্তি, বারবার বলা হয়েছে রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে প্রদীপবাবুকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু শত্রুতার কোনও প্রমাণই আদালতে দেখাতে পারেননি অভিযুক্তের আইনজীবীরা। বরং সাক্ষ্য দিতে গিয়ে মামলার এক নম্বর সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষদর্শী পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রদীপ সাহা-সহ আরও অনেকের উদ্যোগে পূর্বস্থলীতে কলেজ স্থাপিত হয়েছে। তাঁর ভাল কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁরা। শত্রুতা করে সত্য গোপন করেন নি। আর এক সাক্ষী পূর্বস্থলী কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সৌভিক আইচও বলেছেন, ওই কলেজ প্রদীপ সাহার অবদানের কথা। বিকাশবাবুর দাবি, যদি শত্রুতার বশবর্তী হয়ে মামলা করা হয়, তাহলে সাক্ষীরা এ সব সত্য গোপন করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি তাঁরা। তৃতীয় যুক্তি, ওই রাতে ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে এফআইআর দায়ের করা হয়। আইন অনুযায়ী, যত দ্রুত এফআইআর হবে, তার সত্যতা তত বেশি হবে। কারণ সেক্ষেত্রে সত্য বিকৃত করার সম্ভাবনা কম। সওয়াল করতে গিয়ে বিকাশবাবু আদালতের তদন্ত প্রক্রিয়াকেও দায়ী করেন। তিনি জানান, সজল ঘোষ হত্যার তদন্ত ঠিকমতো হয়নি। এই মামলায় মোটিভেটেড ইনভেস্টিগেশন অর্থাত্ মামলার তদন্তে কারও বা কোনও কিছু প্রভাব রয়েছে দাবি করেন তিনি। মঙ্গলবার ফের শুনানি হওয়ার কথা।