তরুণীর দেহ সামনে রেখে চলছে অবরোধ। —নিজস্ব চিত্র।
আত্মহত্যার চেষ্টায় ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক যুগল। ট্রেন চলে যাওয়ার পরেও বেঁচে ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের উদ্ধার করতে দেরি করেন রেল পুলিশের দুই কনস্টেবল। অভিযোগ, জনতাকেও উদ্ধার করতে দিতে রাজি হননি তাঁরা। এর মধ্যে আর একটি ট্রেন এসে দু’জনকে পিষে দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তরুণী। যুবক তখনও ছটফট করছেন। অভিযোগ, এর পরেও প্রায় ৪৫ মিনিট তাদের সরানোর ব্যবস্থা করেননি ওই দুই কনস্টেবল।
মঙ্গলবার সকালে নদিয়া জেলার নবদ্বীপের বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট স্টেশনে ওই ঘটনার পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। দুই কনস্টেবলকে মারধর করে তারা। আহত যুবককে তারাই নিয়ে যায় নবদ্বীপ হাসপাতালে। সেখান থেকে পাঠানো হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। বিকেল ৪টে নাগাদ মৃত্যু হয় যুবকের। তাঁর পকেট থেকে একটি প্যান কার্ড পাওয়া যায়, তাতে ছিল ‘সুমন মণ্ডল’ নামটি। ঠিকানা জানা যায়নি। তরুণীর নাম জানা যায়নি।
ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী প্রায় চার ঘণ্টা কাটোয়া-ব্যান্ডেল রেলপথ অবরোধ করেন। নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “জিআরপির বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসী সেই ক্ষোভেই অবরোধ করেছিলেন। বিষয়টি উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে আশ্বাসে তাঁরা অবরোধ তুলে নেন।” অভিযুক্ত দুই কনস্টেবল শুভ্র বাজপেয়ী (ব্যাজ নম্বর ২১৫) ও সুশান্ত রাজবংশীর (ব্যাজ নম্বর ১০৯৬) বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হলে দেহ তোলার দায়িত্ব রেল পুলিশের। কিন্তু যেখানে ওই যুগল বেঁচে ছিলেন বলে দাবি, সেখানে তাঁদের উদ্ধার করে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে নিয়মের বাধা থাকার কথা নয়। হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মৃণালকান্ত দাস বলেন, “৯টা ৩৬-এ প্রথম ট্রেনটি যায়। ৯টা ৪১-এ পরের ট্রেনটা ঢুকে পড়ে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে দেহ দু’টি তোলা যায়নি। ট্রেনও থামানো যায়নি।”
ঘটনার সূত্রপাত সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ। ডাউন কাটোয়া-ব্যান্ডেল লোকাল বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট স্টেশনে ঢোকার মুখে ট্রেনের সামনে লাফ দেন এক যুগল। ছেলেটির বয়স তিরিশের মতো, মেয়েটির কুড়ি-বাইশ। ট্রেন যাওয়ার পরে সকলে গিয়ে দেখেন, দু’জনেই জীবিত। আসেন কর্তব্যরত দুই রেল পুলিশের কনস্টেবল। কিন্তু অভিযোগ, দু’জনকে উদ্ধার না করে তাঁরা ‘উপরমহলের’ সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তত ক্ষণে চলে আসে একটি আপ ট্রেন। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, ওই সময়ে আপ ট্রেনটিকে থামিয়ে আহত দু’জনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো বাঁচানো যেত। কিছুই করেনি ওই দুই কনস্টেবল।
ওই পথের নিত্যযাত্রী তথা পূর্বস্থলীর তৃণমূল নেতা কাজল বসু বলেন, “প্রথম ট্রেনটি চলে যাওয়ার পরেও দু’জনেই বেঁচে ছিল। দ্বিতীয় ট্রেনটি চলে যাওয়ার পরে ছেলেটির ডান হাত কেটে যায়। মেয়েটি আর নড়াচড়া করেনি।” নিত্যযাত্রীদের ক্ষোভ, এতগুলি মানুষ অনুরোধ করা সত্ত্বেও কেন ওই দু’জন জিআরপি আহতদের উদ্ধার করলেন না, কেন আর একটি ট্রেন যেতে দিলেন, কেনই বা আপ ট্রেনের চালক সব দেখেও ট্রেন চালালেন, তা বোঝা যাচ্ছে না।
অভিযোগ, দ্বিতীয়বার পিষ্ট হওয়ার পরেও প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ওই দু’জন পড়ে ছিলেন রেল লাইনের উপর। হাজারখানেক মানুষ শেষমেশ চড়াও হয় দুই কনস্টেবলের উপর। জনতা রেললাইনে নেমে যুবতীর দেহ প্ল্যাটফর্মে তোলে। মৃতদেহ ঢেকে দেয়। দুই কনস্টেবলের এক জনকে মৃতদেহের কাছে রাখা হয়। এলাকার কিছু যুবক ভ্যান রিকশা জোগাড় করে এনে যুবককে নিয়ে ছোটেন নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। অন্য কনস্টেবলকে জোর করেই হাসপাতালে নিয়ে যান এলাকার বাসিন্দারা। ছেলেটি তখনও বেঁচে, জানিয়েছেন নবদ্বীপ হাসপাতালের সুপার প্রদীপকুমার দাস। তিনি বলেন, “মারাত্মক জখম ওই যুবককে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।” পরে সেখানে মারা যান তিনি।
দুই কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত অবহেলার যে অভিযোগ আসছে, তার তদন্তের ভার রেল পুলিশের ডেপুটি সুপারকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেল পুলিশ সুপার।
সহ-প্রতিবেদন: অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়