আর্সেনিক রুখতে বিপাকে নদিয়ার তিন ব্লক

আর্সেনিক-দূষণ মোকাবিলার জন্য নদিয়ার তিনটি ব্লকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ করে গঙ্গার জল শোধন করে পরিস্রুত জল সরবরাহ প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছিল জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। কিন্তু সেই প্রকল্পে পরিস্রুত জল সরবরাহ করা নিয়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর পড়েছে বিপাকে। কারণ, তাদের অভিজ্ঞতা, কোনও এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা রীতিমতো কলকাঠি নেড়ে নিজের বাড়ির সামনে নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

Advertisement

মনিরুল শেখ

কালীগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৫৪
Share:

নাকাশিপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় এ ভাবেই চলে নেওয়া।—নিজস্ব চিত্র।

আর্সেনিক-দূষণ মোকাবিলার জন্য নদিয়ার তিনটি ব্লকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ করে গঙ্গার জল শোধন করে পরিস্রুত জল সরবরাহ প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছিল জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। কিন্তু সেই প্রকল্পে পরিস্রুত জল সরবরাহ করা নিয়ে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর পড়েছে বিপাকে। কারণ, তাদের অভিজ্ঞতা, কোনও এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা রীতিমতো কলকাঠি নেড়ে নিজের বাড়ির সামনে নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। একই পাড়াতে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে একাধিক পরিশুদ্ধ জলের নলকূপ। গ্রামের অন্য অংশের লোকজন অবৈজ্ঞানিক ভাবে নিজেরাই নলকূপ বসিয়ে নিচ্ছেন, যাতে আর্সেনিক-মিশ্রিত জল উঠছে। আবার কোথাও পরিস্রুত জলের পাইপ ফাটিয়ে জল নিয়ে নিচ্ছে লোকজন।

Advertisement

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের নদিয়া জেলা বাস্তুকার সঞ্জিৎ সরকার বলেন, “বেআইনি নলকূপের জন্য জল সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটছে। জল-দূষণও ঘটছে। আমরা এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু সমস্যা পুরো মেটেনি।”

নদিয়ার উত্তরের তিন ব্লককৃষ্ণনগর-২, নাকাশিপাড়া, কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার টিউবওয়েলের জল পরীক্ষা করে হামেশাই আর্সেনিকের অস্তিত্ব মেলে। শরীরে আর্সেনিক ঢুকলে নানা ধরনের গুরুতর রোগ (এমনকী ক্যান্সারও) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই কারণে ভূগর্ভস্থ জল নিরাপদ নয় ভেবে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর ওই তিন ব্লকে গঙ্গার জল শোধন করে পাইপের মাধ্যমে মহল্লায়-মহল্লায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ হাতে নেয়। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া ২৪৬ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয় বছর তিনেক আগে।

Advertisement

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর স্থির করে, প্রত্যেক ২৫০ জন বাসিন্দাপিছু সরকারি জায়গায় একটি করে নলকূপ বসানো হবে। কোথায় নলকূপ বসবে সে ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। সেই সিদ্ধান্ত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অনুমোদন করলে, তবেই সংশ্লিষ্ট এলাকার নলকূপ বসায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর।

এই মুহূর্তে বেলপুকুর জল প্রকল্পের অধীনে রয়েছে চারটি জলাধার। এর মধ্যে তিনটি রয়েছে কৃষ্ণনগর-২ ব্লকে। অন্যটি নবদ্বীপ ব্লকের বামুনপুকুর-মায়াপুর এলাকায়। জলাধারগুলি থেকে প্রায় পাঁচশোটি নলকূপে প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় জল যায়। একই ভাবে নাকাশিপাড়ার কাশিয়াডাঙা জল প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ন’টি জলাধার। সেখান থেকে ১০৫টি মৌজার প্রায় আটশোটি নলকূপে জল পৌঁছয়। কালীগঞ্জের ভাগ্যবন্তপুর জল প্রকল্পের অধীন সাতটি জলাধার থেকে ১,২৫৬টি নলকূপে জল পৌঁছয়। তবে সরকারি হিসেব অনুযায়ী জনসংখ্যার অনুপাতে তিন ব্লক মিলিয়ে আরও অন্তত পাঁচশোটি নলকূপ থাকা দরকার।

এই যেখানে পরিস্থিতি সেখানে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে সমস্যায় ফেলেছে নলকূপের অসম-বণ্টন। দফতরের আধিকারিকদের খেদ, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, গ্রামে আর্থিক বা রাজনৈতিক ভাবে প্রতিপত্তিওয়ালা লোকজন বাড়িতে নলকূপ থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে ফের বাড়ির আশপাশে নতুন নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। অথচ, সেই গ্রামের অন্যত্র পরিস্রুত জলের নলকূপ বসেনি। জল পেতে অনেকে ইচ্ছেমতো নলকূপ বসাচ্ছেন। সেটা বিপজ্জনক। কারণ, তাতে আর্সেনিক-মেশা জল উঠতে পারে। জলে অন্য দূষিত জিনিস মেশার সম্ভাবনা থাকে। যেমন গত বছর কালীগঞ্জ ব্লকের পলাশি ১ ও ২ নম্বর পঞ্চায়েত ও বড় চাঁদঘর পঞ্চায়েত এলাকার বহু লোকজন জন্ডিসে আক্রান্ত হন। অনেকে আবার পরিস্রুত পানীয় জলের পাইপে ছেঁদা করে জল নিয়ে নিচ্ছেন। ফলে, এলাকার অনেকের বাড়ি পর্যন্ত আর সে জল পৌঁছচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের আধিকারিকেরা শুধু কালীগঞ্জের তিনটি পঞ্চায়েত এলাকাতেই প্রায় তিনশোটি বেআইনি নলকূপকে চিহ্নিত করেন। পুলিশের সহায়তায় সেগুলির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আবার লোকজন এই সব নলকূপ নতুন করে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন বলে খবর রয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কাছে।

অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যাচ্ছে, পুকুরে বা খেতে জল নেওয়ার জন্যও লোকজন পরিস্রুত জলের পাইপ ফুটো করছে। নাকাশিপাড়া থানার অদূরে শোলির তিনচারা মোড়ে জাতীয় সড়কের পাশের পাইপে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি মোটা ফুটো করে জল বার করা হচ্ছে। জল চলে যাচ্ছে পাশের গর্তে ও কৃষি জমিতে। সেই জলেই স্নান করছিলেন এক মাঝবয়সী ব্যক্তি। পাইপে ফুটো কে করল জানতে চাওয়ায় তাঁর জবাব, “বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া জলের পাইপে ফুটো করলে স্নানের জলের অভাব হয় না। লোকে তো ফুটো করবেই।” একই অবস্থা নাকাশিপাড়া ব্লকের কড়কড়িয়া গ্রামে। ওই গ্রামে ঢোকার মুখে মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে জল প্রকল্পের পাইপ। সেখানে সারা বছরই পাইপ ফাটিয়ে খেতে জল নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ফলে, আশপাশের এলাকার লোকজন বঞ্চিত হন পানীয় জল থেকে।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “এ সব কারণেই জল প্রকল্পের উদ্দেশ্য নষ্ট হচ্ছে। নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খানকে এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে।” তৃণমূলের বিধায়ক কল্লোলবাবু অবশ্য বলছেন, “জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সমস্ত গ্রামে নলকূপ বসাতে পারেনি। তাই অনেক জায়গায় লোকজন নিজেদের মতো নলকূপ বসিয়েছে। তাতে আমাদের সায় নেই। নলকূপ কোথায় বসবে সে ব্যাপারে আমাদের দল কোনও হস্তক্ষেপ করেনি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement