মনিগ্রামের সেই বন। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
লিকলিকে, হাড়গিল্লে গাছগুলির দিকে তাকালে কে বলবে মনিগ্রামের সংরক্ষিত বনের বয়স ৭০ বছর ছাড়িয়েছে! সাগরদিঘি ব্লকের মনিগ্রাম, বড়গড়া, চাঁদপাড়া ও বংশিয়া ৪ টি মৌজার প্রায় ১৬০ হেক্টর সরকারি জমিতে ১৯৪৮ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল এই বিস্তীর্ণ বনভূমি। লাগানো হয়েছিল শাল, শিশু, সেগুন, ইউক্যালিক্টাস, আকাশমণি, অর্জুন, মহুয়া-সহ বিভিন্ন ধরণের লক্ষাধিক গাছের চারা। গায়ে গতরে বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছিল বছর পঁচিশের মধ্যেই। কিন্তু সংরক্ষিত সেই বনে বন সংরক্ষণের বালাই ছিল না সেভাবে। দিনের পর দিন তাই দুষ্কৃতীরা বনের মধ্যে ঢুকে সেগুন,শাল, মহুয়া,শিশু ,অর্জুনের মত মুল্যবান গাছ একে একে সব কেটে নিয়ে পালিয়েছে। প্রকাশ্যে দিনের বেলাতেই সবার চোখের সামনেই চলেছে সত্তরের দশকের সেই অবাধ লুঠতরাজ। বাধা দিতে গিয়ে বহুবার মার খেয়েছেন পাহারায় থাকা বনকর্মীরা। আবার অভিযোগ উঠেছে, দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বনকর্মীদের একাংশের যোগসাজশেরও।
বনের পাশেই বাস বাবুরাম রবিদাসের। চাকরিও পেয়েছিলেন এই সংরক্ষিত বনেই, বনকর্মী হিসেবে। পরে বিভিন্ন বন ঘুরে রেঞ্জার হিসেবে এখান থেকেই অবসর নিয়েছেন।
বলছেন, “প্রায় লক্ষাধিক গাছ ক্রমশঃ যত বেড়েছে ততই বেড়েছে স্থানীয় এক শ্রেণির মানুষের উপদ্রব। সত্তরের দশকে দুষ্কৃতীদের দাপটে তাই বন কেটে সাফা হয়েছে। মনিগ্রাম থেকে বংশিয়া ৪টি মৌজার প্রতিটির দূরত্ব ২ কিলোমিটার করে। বিচ্ছিন্ন ১৬ লক্ষ বর্গমিটারের বনভূমি বাঁচাতে গিয়ে বহুবার আক্রান্ত হয়েছেন বন কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত সরকারি নির্দেশে ১৯৭৬ সাল নাগাদ সমস্ত বড় গাছ কেটে বিক্রি করে দেয় বনদফতর।”
বছর সত্তরের লক্ষীকান্ত রাজমল্ল বলছেন, “ছোট বেলায় এই বন ছিল এই এলাকার ছেলে মেয়েদের খেলা ধুলো , বেড়ানোর মনোরম জায়গা। পিকনিকের ভিড়ে উপচে পড়ত শীতকাল। আমরাও বিকেল হলেই চলে আসতাম। গ্রীষ্মের সময় গাছের নিচে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছি। লাগানো গাছ ধীরে ধীরে বড় হতে দেখলাম । দেখতে হল তার নিধনও। চোখের সামনে সাজানো বাগান সব শেষ হয়ে গেল।”
গ্রামের শিক্ষক দেবজ্যোতি দে বলছেন, “বছর কুড়ি পঁচিশ আগে গোটা বন যেন মরুভূমির চেহারা নেয়। এই এলাকার আর্থিক অবস্থা তখন ভাল ছিল না। বনের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত এলাকার কয়েকশো মানুষ।”
তিনি জানান, এখন লোকজনের আর্থিক অবস্থা অনেকটাই ফিরেছে গ্রাম লাগোয়া সাগরদিঘি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠায়। কয়েক হাজার মানুষ সেখানে কাজ করছে। ফলে বনে গাছ কাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফাঁকা বনে বছর দশেক থেকে ফের গাছ লাগানো শুরু হওয়ায় একটু একটু করে যেন প্রাণ পাচ্ছে মনিগ্রামের বনভূমি।”
বনের দায়িত্বে থাকা রঘুনাথগঞ্জের রেঞ্জার শিবপ্রসাদ সিংহ জানান, হারিয়ে যাওয়া বনভূমিকে ফিরিয়ে এনে মনিগ্রামের সংরক্ষিত বনকে আরও সুসংহত করতে ২০১৫ সালেও বন দফতর ৮ হাজার গাছ লাগিয়েছে। এ বছরও ১৯ হাজার নতুন গাছ লাগানো হয়েছে। সে সব গাছকে সুরক্ষা দিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ বন দফতরের ।
এর পরেই তার গলায় যেন হতাশার সুর। বলছেন, “গাছ তো লাগাবো কিন্তু কর্মী কোথাও তা দেখভালের? লালবাগ ও জঙ্গিপুর দুই মহকুমার দায়িত্বে আছি আমি একাই। এখন রঘুনাথগঞ্জ অফিস খোলার লোক নেই বললেই চলে। মনিগ্রামে অত বড় বনে দু’জন মাত্র বনকর্মী। তাহলে বন বাঁচবে কাদের ভরসায়?”