অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির রেড ভলান্টিয়ার্স। নিজস্ব চিত্র
রাত তখন পৌনে ১২টা। রোহান আলির মোবাইলে অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল— “বাবার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যাবে?”
রোহান বার্তা দিলেন তাঁদের গ্রুপে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই পিপিই কিট পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে বাইকে করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়ি পৌঁছে গেলেন আকাশদীপ ঘোষ ও হেমাভ সরকার। আকাশদীপ মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অন্তিম বর্ষের ছাত্র। তিনি কলেজ সামলে সপ্তাহে তিন দিন নিজের শহর কৃষ্ণনগরে করোনা আক্রান্তদের পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবী দলের হয়ে।
পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। হাসপাতালে শয্যা বাড়ন্ত। বাড়িতে হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীরা অক্সিজেন পাচ্ছেন না জরুরি অবস্থায়। অক্সিজেন ও ওষুধের ব্যাপক অভাবের সময়ে সরকারের হাত যেখানে পৌঁছচ্ছে না, সেই ঘাটতি পূরণ করতে সক্রিয় হয়েছে কয়েকটি অসরকারি উদ্যোগ। এর মধ্যে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’-এর মতো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী সংগঠন যেমন আছে, তেমন রয়েছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। তারা কেউ রোগীকে ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে, কেউ বা গাড়িতে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছে রোগীর বাড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের নম্বর ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। রোগীর পরিবার সেই নম্বর দেখে ফোন করলে সাহায্য পৌঁছে যাচ্ছে।
দিন কয়েক আগে ধুবুলিয়ায় এমনই এক করোনা আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কোনও জায়গায় অক্সিজেন না পেয়ে শেষে রোগীর পরিবার যোগাযোগ করেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে। সেই সংগঠনের সদস্য লক্ষ্মণ ব্রহ্ম বলেন, “সে সময়ে আমাদের কাছে অক্সিজেনের একটা ছোট ক্যান ছিল, তা দিয়ে জরুরি পরিষেবা দিয়ে সেই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।” অক্সিজেন জোগাড় করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে বলেও জানান তিনি। দুটো বড় সিলিন্ডার ভাড়ায় জোগাড় করে টোটো করে রোগীর বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও জানান।
সিলিন্ডারের সমস্যার কথা জানান কৃষ্ণনগরের আর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য অনুপ বিশ্বাসও। তিনি বলেন, “প্রাথমিক ভাবে একটি বড় আর একটি মাঝারি সিলিন্ডার জোগাড় করতে পেরেছি। আমাদের লক্ষ্য ‘দুয়ারে অক্সিজেন’।” অনুপদের দলে বেশ কয়েক জন চিকিৎসক ও ডাক্তারি ছাত্র থাকায় তাঁদের পরামর্শ মত দলের ছেলেরা সরাসরি রোগীর কাছে পৌঁছে পরিষেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া একটি দাতব্য ফিভার ক্লিনিকও খুলেছেন তাঁরা।
রানাঘাটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য সুভাষ নাথ জানান, তাঁদের কাছে আটটি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। তাঁরা ভিডিয়ো কলে রোগীর অবস্থা ও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দেখে বিনামূল্যে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।” কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন কাউন্সিলর দিলীপ দাসও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কয়েকটি সিলিন্ডার রেখেছেন যা করোনা আক্রান্তের বাড়ি বিনামূল্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।
কৃষ্ণনগরের চিকিৎসক যতন রায়চোধুরী নদিয়া জেলার ১৩টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের হাতে-কলমে অক্সিজেন দেওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁর কথায় , “শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেই তো হবে না, সেটার ব্যবহার না জানলে তা দেওয়া কঠিন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তা যাতে না হয় সেই কারণেই এই প্রশিক্ষণ।”
‘রেড ভলান্টিয়ার্স এর পক্ষে সমরজিৎ রায় বলেন, “ফোন পেলেই আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া করে রোগীর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তবে সিলিন্ডার পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।” এ ছাড়া তাঁরা আক্রান্তের বাড়ি ওষুধ ও দৈনন্দিন বাজারও পৌঁছে দিচ্ছেন বলে জানান সমরজিৎ।
হয়তো অসম লড়াই। কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এক ঝাঁক তরুণের এই মরিয়া চেষ্টা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথের কথাই মনে পড়াচ্ছে না?