থানা চত্বরে চলছে জলসা। — নিজস্ব চিত্র।
শক্তির আরাধনার রেশ তখনও কাটেনি। মঞ্চের উপরে চলছে উদ্দাম নাচা-গানা। আর মঞ্চের নীচে দর্শকদের ভিড়ে নৃত্যের তালে তালে পা মেলাচ্ছেন কয়েক জন।
তফাতের মধ্যে, যাঁরা পা মেলাচ্ছেন, তাঁদের সকলেরই পরনে পুলিশের উর্দি। আর এই নাচা-গানা চলছে থানা চত্বরেই। স্থানীয় মানুষজন জানাচ্ছেন, কালীপুজো থেকে শুরু করে টানা তিন দিনের অনুষ্ঠান— গোটাটাই চলে খাস থানার নজরদারিতে। স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, কালীপুজোর নামে থানাতে মদের আসর বসে। মঞ্চেও চলে বিশ্রী নাচগান। তাঁদের প্রশ্ন, পুলিশের কি এটা কাজ?
ঘটনাস্থল মুর্শিদাবাদের ভরতপুর।
নামেই সর্বজনীন। ভরতপুরের কালীপুজোর ম্যারাপের বাঁশ পড়ে থানা চত্বরের খোলা মাঠেই। তা নিয়ে হল্লা-মজা, এমনকী চাঁদার ঠাঁটবাট— সবই থাকে থানার নজরে।
পুজো-অন্তে প্রথম হেমন্তের জলসার দায়টাও কাঁধ পেতে ফি বছরের মতো এ বারেও নিয়েছিল থানার পুলিশ।
কী ঘটল সেখানে?
পুলিশের ভাষ্য, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জলসা শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই বহিরাগত দর্শকদের হইচই থামাতে লাঠি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।
আর তারই পাল্টা ছুটে এসেছিল ইট। তার ঘায়ে গুরুতর জখম হয়েছেন মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার ওসি। ইট এবং লাঠির ঘায়ে জখম হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে সাত জনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কালীপুজোর পাশাপাশি টানা তিন দিন ধরে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অনুষ্ঠান শুরুর পরে ঠিকঠাক ছিল সবই। কিন্তু আচমকা অনুষ্ঠানের মাঝপথে, থানার কালীমন্দিরের সামনে নাচানাচি শুরু করে কয়েক জন যুবক। থানা চত্বরের মধ্যেই এমন নাচ দেখে পুলিশকর্মীরা তাদের বকাঝকা করে বের করে দেন।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘মঞ্চের উপর চলছিল উদ্দাম নাচ-গান। পোশাকে থাকা পুলিশ কর্মীরাও পা মেলাচ্ছিলেন। তা দেখে দর্শকদের মধ্যে থেকেও কয়েক জন উত্তেজিত হয়ে পড়ে নাচতে শুরু করলেই আঁতে ঘা লাগে পুলিশের!’’ বাধা দিতেই বাধে বিপত্তি।
পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি পর্ব মিটতে না মিটতেই জনা কয়েক পুলিশকর্মী ব্যারাক থেকে লাঠি নিয়ে এসে দর্শকদের পেটাতে থাকেন বলে অভিযোগ। উত্তেজনা ক্রমেই ছড়াচ্ছে দেখে এ বার এগিয়ে আসেন থানার ওসি স্বরূপ বিশ্বাস। এই সময়ে একটি ইটের টুকরো উড়ে এসে তাঁর কপালে লাগে। রক্তাক্ত স্বরূপবাবুকে নিয়ে পুলিশকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে মঞ্চে গান থেমে যায়। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেন।
এর পরেই ব্যাপক লাঠি চালায় পুলিশ। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘটনাস্থলে আসেন কান্দির এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ সরকার। তত ক্ষণে থানা প্রায় ঘিরে ফেলেছেন গ্রামবাসীরা। কান্দি থানা থেকে বড়সড় পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে মধ্যরাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ওই ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বুধবার কান্দি আদালতে তোলা হলে অতিরিক্ত বিভাগীয় আদালতের বিচারক কৃষ্ণকলি মুখোপাধ্যায় ধৃতদের ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এ দিন সকাল থেকে ফের আশপাশের গ্রামে গিয়ে দৌরাত্ম্য শুরু করে পুলিশ। ফলে গ্রামগুলি প্রায় পুরুষ-শূন্য।
থানা থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে থাকেন সিরাজুদ্দিন। তাঁর বাড়ির লোকের কথায়, ‘‘ছেলে ঘুমিয়ে ছিল। সকালে পুলিশ এসে তাকে বেধড়ক পেটায়। তার পরে নিয়ে যায় থানায়।’’ তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন বলছেন, ‘‘আমি বাধা দিতে গেলে আমাকেও মারধর করা হয়।’’
তাঁর দাবি, ওই দিন রাতে গ্রামেই ছিলেন না তাঁর স্বামী। অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ারও প্রশ্ন নেই। অথচ তাঁকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
হীরা শেখ ও মজল শেখদের কথায়, “কালীপুজোর নামে থানাতে মদের আসর বসে। মঞ্চেও চলে বিশ্রী নাচগান। পুলিশের কী এটা কাজ!’’
থানার ওসি স্বরূপ বিশ্বাস এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ সরকার অবশ্য বলছেন, ‘‘ওখানে একটা গন্ডগোল হয়েছিল মিটেও গিয়েছে।’’ তবে জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলছেন, “ঘটনা ঘটল কেন, সেটাই তো প্রশ্ন।’’
তিনি মনে করেন, থানা চত্বরে এমন অনুষ্ঠান করলে পুলিশের মানমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বলাই বাহুল্য। সাধারণ মানুষের যেটুকু ভরসা আছে সেটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে।
জেলার পুলিশকর্তা প্রশ্ন তুলেছেন বটে, কিন্তু এই ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার কিন্তু কোনও উত্তর মেলেনি!