কলকাতা ও শহরতলির বাইরে ওলা ক্যাব চলে না। স্মার্টফোনের অ্যাপে ডাকার সুযোগই নেই। কিন্তু ফোনে এক হাঁক দিলে রাতবিরেতেও ছুটে আসে টোটো। এ যেন নগর উপান্তের নিজস্ব ওলা-উবের। দেখে এল আনন্দবাজার।
অনেক রাতে কলকাতার বাস। তা-ও ডোমকল থেকে যেতে হবে সেই জলঙ্গি বাসস্ট্যান্ডে। রাস্তায় গাড়িঘোড়া তো আর মিলবে না। আগে থেকেই তাই পাড়াতুতো এক ভাইকে বলে রেখেছিলেন— ‘মোটরবাইকটা নিয়ে আসিস কিন্তু’। সে আসেনি।
এ দিকে বাসের সময় এগিয়ে আসছে। কলকাতা যেতেই হবে। বড় খালা অসুস্থ। মাথায় হাত দিয়ে এক রকম সোফায় বসেই পড়েছিলেন মনিরুল বিশ্বাস।
টেবিল পাখার হাওয়ায় সে রাতে হঠাৎই তাঁর সামনে উড়ে এসে পড়েছিল সেই ভিজিটিং কার্ড। ঝট করে মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেটার মুখটা। নীল টোটোটা ফিরে যাওয়ার আগে ছেলেটির বাড়িয়ে দেওয়া হাত। বলেছিল, ‘‘চাচা, রাতবিরেতে দরকার হলে একটা ফোন মারবেন। ঠিক চলে আসব।’’ মোবাইলে কলটা লাগতেই ও প্রান্ত গেয়ে উঠেছিল, ‘কখন তোমার আসবে টেলিফোন...’। এবং ছেলেটা এসেও গেল। সে রাতে মনিরুল ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাসস্ট্যান্ডে। বলছেন, ‘‘সেই থেকে টোটো-ওলার উপর আমার অগাধ ভরসা!’’
মনিরুল একা নন, এমন ‘টোটো-ওলা’য় মুগ্ধ অনেকেই। ‘‘কলকাতা শহরে ও সব ওলা-উবের আছে। স্মার্ট ফোনে আঙুল ছোঁয়াতেই ঘরের দোরে তাদের ট্যাক্সি হাজির হয়। গ্রামবাংলায় তো সে সব নেই,’’ ঠোঁট উল্টে যাঁরা এ কথা ভাবতেন, তাদের এক রকম বলে বলে জবাব দিয়ে দিচ্ছেন টোটো-ওলারা। একেবারে কার্ড ছাপিয়ে ফোন নম্বর দিয়ে ‘রেডি টু সার্ভ’। সঙ্গে কারও কারও আবার বার্তা, ‘সততাই আমাদের মূলধন’। ফোন ঘোরাতেই চোখের নিমেষে হাজির।
সম্প্রতি মাধবীর একটি শো করতে নবদ্বীপে গিয়েছিলেন নাট্যব্যাক্তিত্ব তথা নান্দীকারের কর্ণধার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠান করে কলকাতা ফিরে যায় নান্দীকারের গোটা দল। কিন্তু ৮০ পার করা রুদ্রপ্রসাদ অভিনয়ের ধকল সামলে সেই রাতে আর কলকাতা ফিরতে চাননি। ঠিক করেন, একটা রাত নবদ্বীপে কাটিয়ে পরের দিন সকালের ট্রেনে কলকাতা যাবেন। এ দিকে রাতভর ঝেপে বৃষ্টি। ‘ট্রেনটা আর ধরা হল না’, ভেবেই ফেলেছিলেন রুদ্রবাবু। মুশকিল আসান করলেন পরিচিতরা। ফোন গেল তাঁদেরই চেনা এক টোটো চালকের কাছে। একটু পরেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাজির টোটো। ব্যাপার স্যাপার দেখে রুদ্রবাবু সে দিন বলেছিলেন—‘‘বাবা, এতো পুরো ওলা-টোটো।’’
তা বটে। মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়ায় বাড়ি আলতাসুন বেওয়ার। খুব ঠেকায় না পড়লে একা বাড়ি থেকে বেরোন না। সে অভ্যেসও নেই। বললেন, ‘‘মাস খানেক আগে এক বার গায়ে গরম জল পড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে তখন ছেলেরা কেউ নেই। কী করি? কোনও দিন একা ডাক্তারখানায় যাইনি। এক টোটোচালককে ফোন করে ডাকতেই চলে এলেন। মেয়েদের নিয়ে চেপে বসি টোটোয়।’’ এখন একা বেরনোর দরকার হলেই আলতাসুন টোটো ডেকে নেন।
রোদে পুড়ে ঘেমেনেয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ি ফেরার সময় কিংবা বিকেলে হাওয়া খেতে বেড়ানো— টোটো হাজির।
বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন? দু’হাতে এক গাদা মালপত্তর? স্টেশনে হাজির টোটো।
অচেনা শহর। একটু আনাচে কানাচে ঘুরে দেখবেন? টোটো হাজির।
স্রেফ টো টো ঘুরে বেড়াতে হলেও টোটো হাজির। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, যে কোনও অনুষ্ঠানে টোটো হাজির।
করিমপুরের বাসিন্দা জয়ন্ত সাহা যেমন তৃপ্তির সুরে বললেন, ‘‘ফেল কড়ি, মাখো তেল। ১০ কিলোমিটারে মাত্র ১০ টাকা।”
যাঁদের ঘিরে এত হইচই, সেই টোটো-ওলারা কী বলছেন তাঁরা?
এক গাল হেসে টোটো চালক মুক্তিদহ গ্রামের বাসিন্দা প্রহ্লাদ প্রামাণিক বললেন, “এলাকার যাত্রীরা সকলেই আমাদের মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখেন। গাড়ির গায়ে তো মোবাইল নম্বর থাকেই। আগে কাগজে নম্বর লিখে দিতে হতো। এখন ভিজিটিং কার্ডই বানিয়ে নিয়েছি। ব্যবসা ভালই চলছে।’’
নবদ্বীপের টোটো চালক তপন দত্ত জানাচ্ছেন, তাতে ফলও মিলছে হাতেনাতে। যখন যাঁর দরকার, তিনি তখন বাড়িতে ডেকে নিচ্ছেন। বাজারের মালপত্র নিয়ে দশ টাকার বিনিময়ে পৌঁছে যাচ্ছেন এক দম বাড়ির দোরগোড়ায়।
নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন জনপথ নবদ্বীপ শহরের গলি থেকে তস্য গলিতে পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্যও আদর্শ যান এই টোটো। জেন এক্স কলকাত্তাইয়ারা বলছেন, ‘‘এমন দুষণহীন যানে ট্রাভেল করাটা হেব্বি থ্রিলিং।’’
রাজার শহর হলে কী হয়, হাতিশালে হাতি, আর ঘোড়াশালে ঘোড়ার দিন আর নেই। তাই কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মনও আজ টোটোতেই নিবেদিত। আমিন বাজারের মৃণালকান্তি বিশ্বাস বলছেন, অনেক টোটোওলাই তাঁদের নম্বর দিয়ে রেখেছেন। প্রয়োজন মতো বাড়িতেই ডেকে নিই। এমনও হয়েছে, তাঁরা দূরে কোথাও রয়েছে। ফোন করে তাঁরা অন্য টোটো পাঠিয়ে দেন।
টোটোর রমরমায় আবার বাজার পড়েছে রিকশার। অনেকে হাওয়া বুঝে রাতারাতি বদলে ফেলেছেন পেশাও। সুকুল পাড়ার জামাল শেখ যেমন আগে রিকশা চালাতেন।
এখন একটা টোটো কিনে ফেলেছেন। রিকশা চালানোর সময় থেকেই তাঁর মোবাইল নম্বর যাত্রীদের কাছে দেওয়া ছিল। এখন তাঁর নম্বর নিয়ে নিয়েছে আরও অনেকে। ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব। হাত কচলাতে কচলাতে জামাল বললেন —‘‘তা দাদা, ভালই চলছে সব কিছু।’’
কৃষ্ণনগর শহরের টোটো চালক অ্যাসোসিয়েসনের সম্পাদক তপন কুণ্ডু বলেন, ‘‘ওলা-উবেরের মতো সার্ভিস দেওয়ার পরিকাঠামো বা অর্থ আমাদের নেই। তাই চালক-ভাইরা নিজেদের মতো করেই এমন ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।’’ কৃষ্ণনগরে এখন প্রায় দেড় হাজার টোটো। তাদের বেশির ভাগের গায়েই ফোন নম্বর লেখা। যাত্রীরা মোবাইল ফোন বার করে ক্যামেরায় তার ছবিও তুলে ফেলেন পটাপট। আর এখন তো হাতে গরম ভিজিটিং কার্ড। হাঁক দিলেই হাজির টোটো-ওলা।
তথ্য সহায়তা: সুজাউদ্দিন, কল্লোল প্রামাণিক, সুপ্রকাশ মণ্ডল, অনল আবেদিন, গৌরবময় বিশ্বাস