হাসপাতালের শয্যায় তখন নৈশ-আড্ডা চলছে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
চুপ করে থাকা রাত হঠাৎ কঁকিয়ে ওঠে।
হাসপাতালের জ্যালজ্যালে সবুজ পর্দা, পুরনো টাইলসে কবেকার রক্ত-ছিটে আর সস্তা ফিনাইলের ভারী গন্ধ উজিয়ে কে যেন কাঁদছে।
খাঁ খাঁ করিডরে নার্সের নির্বিকার হাইহিল ঠক ঠক করে হারিয়ে যায়। আর, তাঁর পাশ কাটিয়ে হন্তদন্ত ওয়ার্ডবয় মোবাইল কানে ছুটছে— ‘‘হ্যাঁ স্যার, এই মাত্র বডিটা বেরিয়ে গেল, পেমেন্ট নিয়ে কিছু বলব স্যার!’’
তার পর আবার সব চুপচাপ। শুধু দমকে দমকে দোতলা থেকে গড়িয়ে আসা ফোঁপানো কান্না আর বর্যার ভিজে হাওয়া। কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে নেমে আসে মধ্যযাম।
মেল ওয়ার্ডে তখনও ঘুম আসেনি। দুটো খাট কাছাকাছি এনে— ভগ্ন পা, হাতে প্লাস্টার না হয়, মাথায় সাতাশ সেলাই নেওয়া চোট-আঘাতের রোগীদের তাসের আড্ডা। পাশের শয্যায় শরীর দুমড়ে শ্বাস কষ্টে ছটফট করছেন এক বৃদ্ধ।
নার্সের টেবিল ফাঁকা। দু’হাত দূরে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বিনা ব্যবহারে ঠায় দাঁড়িয়ে। নাঃ, কোনও চিকিৎসকও নেই।
রাতের হাসপাতালে সারমেয় শাসন। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
তবে তাঁরা আছেন। সবুজ পাড় সাদা আধ-ময়লা শাড়ি, আয়া। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে যাঁদের একটু জলের জন্য ক্ষিণ গলায় ডেকেই চলেছেন ফিমেল ওয়ার্ডের রোগিনী, ‘‘দিদি, একটু জল দাও না গো,
ও দিদি...।’’
রাতের ম্যাড়ম্যাড়ে টিউব লাইটের আলোয় সে ডাক কি কেউ শুনতে পাচ্ছেন? তাঁর ‘দিদি’র অবশ্য সময় নেই, মোবাইলে টানা কথন কী অত সহজে শেষ হয়, নার্সের অনুপস্থিতিতে চেয়ার যে এখন তাঁর!
হৃদরোগে আক্রান্ত আবদুল খালেককে নবগ্রামের মুকুন্দপুর থেকে নিয়ে এসে ভর্তি করানো হয়েছে খানিক আগে। পরিবারের লোকজন মুখে কাপড় দিয়ে ফিসফিস করছেন, ‘‘আয়াদের কী মুখ, বলছে, বুকে ব্যাথা কী রাতেই উঠতে হল!’’ মোবাইলের আড়ালে গুমরে গুমরে আয়া ‘দিদি’র হাসির সামনে পেশেন্ট পার্টি দাঁড়াতেই সাহস পায় না!
আর, মহিলা বিভাগে ঢোকার মুখে বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় পলিথিন পেতে বসে থাকা জুলেখা বিবির পরিজনেরা বলছেন, ‘‘রাত শেষ হতে চলল গো মেয়েটাকে একটা ডাক্তারও দেখল না।’’ শয্যায় দ হয়ে শুয়ে যন্ত্রণাকাতর বেলডাঙার জুলেখা বলছেন, ‘‘রাতে কোনও ডাক্তারের মুখ দেখা যা না গো, একটা মরণের বড়ি যদি পেতাম!’’
সরকারি হাসপাতালে দিনেও কি কেউ কাউকে দেখেন? চিকিৎসক, আয়া, নার্স— না দেখুক, একটু ভাল ব্যবহার, মিঠে কথা, স্তুতি, ভরসা...। রাতের দুই হাসপাতালে সে সব আঁধারেই হারিয়ে থাকল।
তবে, তাঁরা আছেন। আঁধার ফুঁড়ে অনায়াস, সাবলীল এবং চাইলেই চোখের ইশারায় এগিয়ে আসার তৎপরতা নিয়ে— ফড়ে, দাদাল, আর হাসপাতালের করিডর জুড়ে অভ্যস্থ লেজ-নাড়া নিয়ে এক ঝাঁক সারমেয়কুল। কৃষ্ণনগর আর বহরমপুর, দুই জেলা সদরের হাসপাতালে তাদের রং-চেহারা-স্বভাব সবই যেন একইরকম।
কৃষ্ণনগরের হাসপাতালের কর্মীরা ফিসফিস করছেন— হাসপাতালের মাঠে মদের ঠেকটা নিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহরমপুরের হাসপাতালের দেওয়াল ঘেঁষেও চোখের ইশারায় চোলাই অনায়াস। হন্যে হয়ে ওষুধের দোকান খোঁজা ছেলেটির সামনে এসে এক জন ধোঁয়ার রিম ছেড়ে জানতে চায়— ‘‘কী ভাই, দিশি না বিলিতি?’’
চাপড়ার গহিন গ্রাম থেকে আসা ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, আর দোতলায়, মেডিসিন ওয়ার্ডে ধীরে ধীরে নিভে আসে আলো।
শ্বাসকষ্টে ভোগা তার বাবাও কি নিভে এল— নিশ্চুপ হাসপাতালের ঘরঘরে মাইক ভেঙে দেয় স্তব্ধতা, ‘বেড নম্বর ৬৮, পেশেন্ট পার্টি দেখা করুন।’