ঘাসফুল ওপড়াবে মন্টুর খোয়াব, হাসছেন তোয়াব

রং পাল্টানো, দলবদল, পুরসভা আর পঞ্চায়েত দখলের রাজনীতি। এখন তৃণমূলের হাতে থাকা ধুলিয়ান পুরবোর্ডও সেই জবরদখলেরই সাক্ষী।

Advertisement

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৬
Share:

রং পাল্টানো যেন মজ্জাগত!

Advertisement

রং পাল্টানো, দলবদল, পুরসভা আর পঞ্চায়েত দখলের রাজনীতি। এখন তৃণমূলের হাতে থাকা ধুলিয়ান পুরবোর্ডও সেই জবরদখলেরই সাক্ষী।

সমশেরগঞ্জ বা ধুলিয়ানের ভোটে চমক তাই থাকেই। এ বারও তা-ই।

Advertisement

চমক ১: দুপুর পর্যন্ত যিনি ব্লক কংগ্রেস সভাপতি, বিকেল গড়াতেই তিনি তৃণমূল প্রার্থী।

চমক ২: জেলা তৃণমূল সভাপতি ও পর্যবেক্ষকের ঘোষণা মতো এক বছর আগে থেকে যাঁর নাম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বাতাসে উড়েছে, সেই মন্টু বিশ্বাস ওরফে রেজাউল হক টিকিট পাননি। ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ মন্টু তাই “ব্যাট” হাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে। তাঁর মনোয়ন দাখিল হতেই তৃণমূলের নানা কমিটির একাধিক স্থানীয় নেতা হয় অপসারিত হয়ে অথবা পদত্যাগ করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উইকেট আগলাতে।

বিড়ি ব্যবসায়ী মন্টু কস্মিন কালেও রাজনীতি করেননি। ছিলেন ব্যবসাপত্র নিয়েই। তাঁকে খুঁজে-পেতে বের করেছিলেন জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন। তাঁর কথায় দাঁড়াতে রাজিও হয়ে যান মন্টু।

তার পরেই বিনা মেঘে বজ্রপাত!

এক বেলায় দল বদলে প্রার্থী হয়ে সমশেরগঞ্জে তৃণমূলের ঘরটাকেই রাতারাতি বেসামাল করে দিয়েছেন প্রাক্তন কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি আমিরুল ইসলাম। এখন ধুলিয়ানে চায়ের দোকান থেকে অফিস-বাজার-হাট সর্বত্র মুখরোচক হয়ে উঠে আসছে এই কোন্দলের কাহিনি।

গত বিধানসভা নির্বাচনে যিনি সিপিএমের প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন, সেই তোয়াব আলিই এ বার ফের তাদের প্রার্থী। এর আগে ছ’বার দাঁড়িয়ে তিনি চার বার জিতেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপি ১১ শতাংশ ভোট পকেটে পোরায় সিপিএম দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে। জিতে যায় কংগ্রেস। একক শক্তিতে মাথা তোলে তৃণমূলও। ১২ শতাংশ ভোট পায় তারা।

এর পরে কেটে গিয়েছে প্রায় দু’বছর। ইতিমধ্যে বিজেপি ও কংগ্রেস থেকে কর্মীদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের দিকে ভিড়ে যাওয়ায় তাদের বাড়বাড়ন্ত হতে থাকে। তৃণমূলের এক প্রাক্তন ব্লক সভাপতি র দাবি, “প্রার্থী হিসেবে আমরা দু’জনের নাম জেলার নেতাদের কাছে জানিয়েছিলাম। তাঁরা প্রার্থী হলে হাসতে-হাসতে তৃণমূল সামশেরগঞ্জ দখল করত। কিন্তু সব কিছু এক রাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেল!”

তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের যত রাগ এখন গিয়ে পড়েছে স্থানীয় এক পুলিশ অফিসারের উপরে। ব্লকের ওই নেতার কথায়, “উপর তলার নেতাদের সঙ্গে ওই অফিসারের যথেষ্ট দহরম-মহরম। তিনিই উপরতলার নেতাদের ভুল বুঝিয়েছেন। আর তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতেই রাতারাতি দল বদলে আমিরুল ইসলাম তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন।”

ক্ষোভে তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন সাত অঞ্চল সভাপতি। পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্লক সভাপতি কাওসার আলিকে। কাওসার বলছেন, “আমরা সমশেরগঞ্জে যে লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলাম, তা এ ভাবে শেষ করে দেওয়া হবে, ভাবতে পারিনি। নিরুপায় হয়েই দলের আশি শতাংশ নেতাকর্মী নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নেমেছেন। লক্ষ্য একটাই, তৃণমূলকে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে দেওয়া এবং সিপিএমকে হারানো।’’ তাঁর আশা, আজ যে নেতারা উপেক্ষা করেছেন, এক দিন তাঁরাই তাঁদের দলে ফেরাতে আকুলিবিকুলি করবেন।

মন্টুও বলছেন, “তৃণমূল আমাকে বেইজ্জত করেছে। কিন্তু দলের পুরো সংগঠন আমার সঙ্গে কাজ করছে। আমি নির্দল প্রার্থী হলেও এলাকার ২২০টি বুথে কমিটি গড়ে প্রচারে নেমেছেন আমাদের কর্মীরা।”

সমশেরগঞ্জের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা তপন সরকারের দাবি, “কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোটের অঙ্ক শুরুর অনেক আগেই সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার জন্য উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। যতই জোটের মিছিল বের হোক, ডানপন্থী ভোটের সিংহ ভাগই যাবে মন্টু বিশ্বাসের ঝুলিতে।’’ তাঁর হিসেব অনুযায়ী, সাতটি পঞ্চায়েতের মধ্যে চারটিতে এবং ধুলিয়ান পুরসভায় এক নম্বরে থাকবেন মন্টুই।

আমিরুল অবশ্য এ সব শুনে হাসছেন। তাঁর ধারণা, “নির্দল প্রার্থীকে মানুষ বিশ্বাস করে না। কোটি টাকা খরচ করলেও বিশ্বাস করানো যায় না। মিছিল করে চমকানো যায়, ভোটে জেতা যায় না।’’ তাঁর বিশ্বাস, এখনও তৃণমূলের ৯০ শতাংশ কর্মী-সমর্থক দলের মূলস্রোতেই আছেন। বরং তিনি প্রার্থী হওয়ায় বহু কংগ্রেস কর্মীও তাঁর হয়ে প্রচারে নেমেছেন।

ধুলিয়ানের তৃণমূল পুরপ্রধান সুবল সাহাও দাবি করছেন, “লড়াইটা তো রাজনৈতিক। হচ্ছে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের । এখানে নির্দলের কোনও স্থান নেই। কংগ্রেস সমশেরগঞ্জে জোট করে সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি। বহু কংগ্রেস কর্মী ও সমর্থক এই জোট মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা বিকল্প হিসেবে তৃণমূলকেই বেছে নিচ্ছেন।”

গত দু’টি ভোটের পাটিগণিত সামনে রাখলে জোটপ্রার্থী তৃণমূলের চেয়ে কয়েকশো মাইল এগিয়ে। কিন্তু জোটটা ঠিকঠাক কাজ করছে তো? কংগ্রেস কর্মীরা এত দিনের লালিত সংস্কার ঝেড়ে ফেলে সিপিএমের সঙ্গে যাবেন তো? কংগ্রেসের ধুলিয়ান শহর সভাপতি কাশীনাথ রায় বলছেন, “দ্বিধাদ্বন্দ্ব এক সময় ছিল ঠিকই। কিন্তু জোট যখন হয়েছে, তোয়াব আলি যে প্রতীকেই লড়ুন, তিনি জোটের প্রার্থী। দুই দল মিলে সভা-মিছিল চলছে। বুথস্তরে যৌথ কমিটি হয়েছে। প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী সভা করবেন ১২ এপ্রিল। এখানে অন্তত জোট নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।”

তোয়াব আলিও বলছেন, “জোট প্রার্থী হিসেবে আমার কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোনও ঘাটতি নেই। লক্ষ্য যখন তৃণমূলকে উৎখাত করা, আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। তৃণমূল দু’বার দল ভাঙিয়ে ধুলিয়ান পুরসভা দখল করেছে। মানুষ কিন্তু এটা ভাল ভাবে নেয়নি।”

ধুলিয়ানের ধুলো উড়িয়ে মধুর প্রতিশোধের খোয়াব বুনছেন তোয়াব।

বুনছেন মন্টুও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement