৫ পঞ্চায়েত, ৫৬ সদস্য, ৯ দিন

চাপড়ায় অনাস্থায় জিততে মরিয়া তৃণমূল

চাইলেই হাতের কাছে গাড়ি। দু’বেলা জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যাবেলা খিদে খিদে পেলে মাছ ভাজা। ইচ্ছে মতো দিঘায় সমুদ্র স্নান। কিংবা স্রেফ সাগরের হাওয়া খাওয়া। বলা হচ্ছে শর্ত নাকি একটাই। ভোট দিতে হবে তৃণমূলকে। ভোট দিতে হবে অনাস্থার পক্ষে।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর  শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৬ ০৭:৪১
Share:

চাইলেই হাতের কাছে গাড়ি। দু’বেলা জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যাবেলা খিদে খিদে পেলে মাছ ভাজা। ইচ্ছে মতো দিঘায় সমুদ্র স্নান। কিংবা স্রেফ সাগরের হাওয়া খাওয়া।

Advertisement

বলা হচ্ছে শর্ত নাকি একটাই। ভোট দিতে হবে তৃণমূলকে। ভোট দিতে হবে অনাস্থার পক্ষে।

অবস্থা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, সেই শর্তে রাজি হয়েছেন চাপড়া ব্লকের বৃত্তিহুদা, আলফা, বাগবেড়িয়া, কলিঙ্গ আর চাপড়া-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল আর এক জন বিজেপি সদস্য সহ মোট ৫৬ জন। আর তাতেই তাঁদের ভাগ্যে খুলে গিয়েছে সপরিবারে সমুদ্রতট ভ্রমণের সুযোগ। আর তাদের পরিবার, অনুগামী ও দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে মোট সংখ্যা হল ১৭২ জন। সব মিলিয়ে ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৬৩টি।

Advertisement

যাতায়াত, খাওয়া-থাকা ‘ফ্রি’। তবে কেনাকাটা নিজেদের দায়িত্বে। ১৪ জুন সকাল থেকে তাঁরা এক সঙ্গে রয়েছেন। অনাস্থা নিয়ে ভোটাভুটি ২৩ জুন। তার আগের দিন তাঁরা বাড়ি ফিরবেন।

শিলিগুড়ি পুরসভা ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহরে যাওয়ার ঠিক আগে নিজের দলের সদস্যদের নিয়ে দার্জিলিং চলে গিয়েছিলেন সিপিএমের অশোক ভট্টাচার্য। যে নির্দলের সাহায্য নিয়ে তাঁরা বোর্ড গড়েন, সেই অরবিন্দ ঘোষও সে দিন শিলিগুড়িতে ছিলেন না। তৃণমূল দল ভাঙিয়ে নিতে পারে, এই আশঙ্কাতেই যে তাঁরা দলবল নিয়ে শহর ছেড়েছিলেন, তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন বামেরা। এ বার সেই একই কায়দা নিয়েছে তৃণমূল। চাপড়া ব্লকের মোট ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টি ইতিমধ্যেই তৃণমূলের হাতে। চারটি তারা ভোটে জিতে দখল করেছিল। দু’টি দখল করেছে সদস্যরা দলবদল করায়। সেই একই ভাবে এ বার ওই ব্লকের আরও ৫টি পঞ্চায়েতও তাদের দখলে যাওয়ার পথে। এই পাঁচটির মধ্যে চারটি ছিল সিপিএমের হাতে। একটিতে তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় ছিল। প্রধান ছিলেন বিজেপির। সেটিও এ বার পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিতে চায় শাসক দল। সে জন্য অনাস্থা আনা হয়েছে ৫টি পঞ্চায়েতেই। সব ক’টিরই ভোটাভুটি বৃহস্পতিবার। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা বলেন, ‘‘কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছি না আমরা। তাই ওই পঞ্চায়েতগুলোতে যাঁরা দলবদল করে আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছেন, তাঁদের এক সঙ্গে রাখা হয়েছে।’’

নিউ দিঘায় এই সদস্যদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন চাপড়া ব্লকের তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদর জেবের শেখ। তিনিই এই ‘ট্যুরের’ কর্তা। সব টুকুর দায়িত্বে তিনিই। তাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চরকির মতো ঘুরছে তার চোখ। কোথাও কোন ছন্দ কাটল না তো? জেবের বলেন, ‘‘আসলে এই সদস্যরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে চাইছেন। সেই কারণেই তাঁরা আজ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছেন। তাদের ঠিকঠাক ভাবে রাখার দায়িত্ব আমাদের।’’ কিন্তু সকলকে এক সঙ্গে এত দিন রেখে দেওয়া হচ্ছে কেন? তাঁর কথায়, ‘‘আসলে এক সঙ্গে থাকলে সকলেই একটু খুশি হন। তা ছাড়া বিরোধীরা অনাস্থা ভোটের আগে এই সদস্যদের ক্ষতি করে দিতে পারে, যাতে তাঁরা অনাস্থা ভোটে আসতে না পারেন। অন্য কোনও কারণেও তাঁরা আসতে পারল‌েন না, এমনও তো হতে পারে। সেই কারণেই সকলকে এক সঙ্গে রাখা।’’

কেন এমন মরিয়া হয়ে তৃণমূল এই ৫টি পঞ্চায়েত দখল করতে চাইছে?

চাপড়ার বিধায়ক রুকবানুর রহমান বলেন, ‘‘আসলে আমাদের দলে যোগ দেওয়া ওই সদস্যদের অনেকেই চাইছিল যে এই কটা দিন এক সঙ্গে মিলে আনন্দ করবেন। তাঁরা চাইছিলেন বলেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসলে তারা নানান কারণে এক সঙ্গে থাকতে চাইছেন।’’ তিনি বলেন, ‘‘তা ছাড়া অনাস্থা ভোটের সময় বিভিন্ন কারণে সদস্যের কারও কারও উপস্থিতে সমস্যা হতে পারে। হয়ত কোনও কারণে পৌঁছাতে পারলেন না, এমনও তো হতে পারে। এক সঙ্গে থাকলে সেই সম্ভাবনা থাকে না।’’ তবে রুকবানুর রহমান স্বীকার না করলেও দলেরই এক অংশের দাবি, এত গুলো সদস্য এক সঙ্গে তাদের দলে যোগ দেওয়ায় এত দিন ধরে তাদের সকলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। কারণ সিপিএম বা কংগ্রেসের তরফে তাদের বোঝানোর চেষ্টা চলত। তাতে কারো কারো আবার পুরনো দলে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেই ঝুঁকিটাই আসলে তৃণমূল নিতে চায়নি। তাই তাদের চাপড়া থেকে বাইরে নিয়ে আসা হল।

তা না হয় হল। দলীয় সূত্রে খবর, এই ক’দিনে সাড়ে চার থেকে ৫ লক্ষ টাকা খরচ ধরা হয়েছে, এত টাকা দিচ্ছে কে? যাকে বলে ‘বাজেট’? এক গাল হেসে ব্লক তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘‘কেন গৌরী সেন। শাসক দলের আবার গৌরী সেনের আভাব হয় নাকি? পাঁচ পাঁচটা পঞ্চায়েত। টাকার দিকে তাকালে চলে?’’

চাপড়া থেকেই তাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘ক্যাটারার’। একটা হোটেলের ছাদে ত্রিপল টাঙিয়ে প্যান্ডেল করা হয়েছে। সকাল থেকে চলছে রান্না। সকালে লুচি তরকারি। দুপুরে ভাত, ডাল, সব্জি অথবা চিংড়ি পটল। মাছ অথবা মাংস। সেই তালিকায় খাসিও রয়েছে, আছে মুরগিও। রাতে ভাত, ডাল, সব্জি আর ডিমের কারি। রুটি খেতে চাইলে সেটাও হাজির সঙ্গে সঙ্গে। সিপিএমের আলফা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য আতায়ার রহমান ফারাজি কিংবা বৃত্তিহুদার কালু মন্ডলরা রীতিমতো পান চিবাতে চিবাতে বলেন, ‘‘কোনও সমস্যা নেই। যখন যা দরকার, পেয়ে যাচ্ছি। আলাদা ঘর। বেড়াতে যাওয়ার গাড়ি, সব কিছু। জেবের শেখকে আমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।’’

যা শুনে সিপিএমের জেলা কমিটির সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘দিঘায় বেড়াতে যাওয়াটা আসলে অ-নৈতিকতার শুরু। এটা ছোট বিষয়। ওই সদস্যরা আসলে আরও বড় অনেতিক রাস্তায় হাঁটার জন্য তৃণমুলে যোগ দিয়েছেন। মানুষ সব দেখছে।’’

মানুষ তাদের সত্যিই দেখছে কি না, সেটা হয়ত এখনই পরিষ্কার হবে না। তবে তারা যে মানুষের ভোটে জিতে প্রাণের সুখে দিঘার সমুদ্র সৈকত দেখছেন সেটা কিন্তু পরিষ্কার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement