ফাইল চিত্র
এখনও কাজল চক্রবর্তীর ঘরের আলমারিতে কিংবা পরেশ নন্দীর দোকানের শো-কেসে বান্ডিল করে বাঁধা আছে বিয়ের কার্ডগুলো। বিলি করার দরকারই পড়েনি।
শহরের পরিচিত সঙ্গীতশিল্পী কাজল চক্রবর্তীর মেয়ে কোয়েলের সঙ্গে আদিত্য সিদ্ধান্তের বিয়েতে দু’পক্ষের মিলিত নিমন্ত্রিতের সংখ্যা ভাবা হয়েছিল শ'পাঁচেক। মাসচারেক আগে রেজিস্ট্রি হয়। ২১ বৈশাখ মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল। ভাড়া করা হয়েছিল বাড়ি। ছাপানো হয়েছিল তিনশোর বেশি বিয়ের চিঠি। কিন্তু শেষমপর্যন্ত দুপক্ষের হাতে গোনা পঁয়তাল্লিশ জন আত্মীয়-পরিজনের উপস্থিতিতে নমো নমো করে সারতে হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান।
একই অবস্থা পরেশচন্দ্র নন্দীর ছেলের বিয়েতেও। বৈশাখে তখন কড়া লকডাউন চলছে দেখে ঠিক করেছিলেন বিয়ে পিছিয়ে দেবেন। কিন্তু মেয়ের বাড়ির অনুরোধে ওই দিনই বিয়ে হয়। প্রায় তিনশো লোকের আয়োজন করার কথা ভেবেছিলেন। নিজের ঘড়ির দোকানের শো-কেসে এখনো ঠাসা কার্ড। পরেশ নন্দী বলেন “এই ভাবে ছেলের বিয়ে দিতে হবে কখনও ভাবিনি। শুধুমাত্র আমাদের দুই বাড়ি সব মিলিয়ে জনাপনেরো। বাইরের লোক বলতে রেজিস্ট্রার আর পুরোহিত মশাই।” কষ্ট দেয়, বিলি না হওয়া নিমন্ত্রণপত্রের গোছা।
করোনা আবহে সবই বাদ দিতে হয়েছে। কিন্তু বাদ দিলেন কী করে? জবাবে পরেশ নন্দী বা আদিত্য সিদ্ধান্তেরা জানাচ্ছেন, বাড়ির বাইরের কাউকে বলাই হয়নি। প্রাচীন মায়াপুরের পরিমল দাস তাঁর ভাইপোর বিয়ের প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা প্রতিবেশী কাউকেই বলতে পারিনি। পঞ্চাশ জনের মধ্যে কাকে বলব, কাকে বাদ দেব?” এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে দূরের পরিজনদের জানানো হয়নি।
করোনা আবহে বাঙালি বিয়ের যে চেনা ছবি, তা আমূল বদলে গিয়েছে। বিয়েবাড়ি মানেই ছিল তিন-চার দিনের লম্বা একটা পারিবারিক পুনর্মিলনের নিটোল আয়োজন। বহুকাল দেখা হয়নি এমন মানুষদের একছাদের তলায় আসা, খাওয়া-দাওয়া, হইহুল্লোড়। সে সবই এখন স্মৃতি। করোনা পরিস্থিতিতে যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে পঞ্চাশ জনের বেশি জড়ো হওয়াই নিষিদ্ধ।
যা দেখে প্রবীণেরা কেউ কেউ বলছেন, এই সংক্ষেপিত আয়োজন তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ছয়ের দশকে খাদ্য আন্দোলনের সময়ে নিমন্ত্রিতের তালিকায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের কথা। সমাজবিজ্ঞানীরা অবশ্য এর ভাল-মন্দ— দুটো দিকই দেখছেন। তাঁরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ের বিপুল খরচ অনেককেই ধারদেনা করে জোগাড় করতে হত। এখন করোনার কারণে সেই খরচ বেঁচে যাচ্ছে।
সরকারি নির্দেশ মাফিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে জমায়েত হওয়া পঞ্চাশ জনকেই যথাবিহিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক পরে আর যাই হোক স্ত্রী আচার, গায়ে হলুদ, কুলো-ডালা দিয়ে বর বা কনেকে বরণ করা যায় না। যার ফলে, মার খাচ্ছেন বিয়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্য পেশার মানুষজন। প্রাচীন মায়াপুরের সন্তোষ দাসের ছেলের বিয়ে ছিল ১৭ জ্যৈষ্ঠ। কোনও ঝুঁকি নেননি তাঁরা। সকালবেলায় একটি গাড়িতে বরকে নিয়ে আরও তিন-চার জন মিলে মাজদিয়া মেয়ের বাড়ি পৌঁছে গিয়ে দিনের বেলাতেই নিয়মরক্ষার বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ করেছেন। সন্ধের মধ্যে ছেলে-বউ নিয়ে ফিরে এসেছেন বাড়ি।
নবদ্বীপের পুরোহিত সুশান্তকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখন বিয়েতে আমাদের দরকার লাগছে না। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ চার মাসে বিয়ের দিন ছিল গোটা কুড়ি-বাইশ। বেশির ভাগই বাতিল হয়েছে। কবে হবে, ঠিক নেই। আর যাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে ফেলছেন, তাঁরা অধিকাংশই শুধুমাত্র কাগজে-কলমে রেজিস্ট্রি করাচ্ছেন।”
বিশেষ করে, ক্যাটারিং ব্যবসার অবস্থা রীতিমতো বেহাল। এক ক্যাটারিং ব্যবসায়ী নিতাই বসাক বলেন, “তিন-চারশো লোকের কথা এখন আর ভাবছি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যাঁরা বিয়ের করছেন, তাঁরা চল্লিশ পঞ্চাশ জনের খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন। আমরা রান্না করে নিয়ে গিয়ে সার্ভ করে আসছি। কোথাও আবার প্যাকেটও নিচ্ছেন।”