জেলায় তো বটেই তাদের হাতে তৈরি পড়ুয়ারা রাজ্যেও মুখ উজ্জ্বল করছে স্কুলের। দু’এক বছর নয়, ধারাবাহিক ভাবে ভাল ফল করে আসছে জেলার বেশ কিছু স্কুল। তাদের সেই সাফল্যের পিছনে রহস্যটা কী, তা জানতে কান পেতেছিল আনন্দবাজার। তাতে কোনও স্কুল শোনাল পড়ুয়াদের উপর ‘বিশেষ নজর’ দেওয়ার কথা। কেউ শোনাল শিক্ষকদের ঘাম ঝরানোর গল্প।
মহারানি কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়
দু’শ বছরেরও আগের কথা। বছর চব্বিশের রাজা কৃষ্ণনাথ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য সমস্ত সম্পত্তি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আইনি মারপ্যাচে সে উইল বাতিল হয়ে যায়। কাশিমবাজারের সেই রাজার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ডিরোজিওর ভাবশিষ্য কৃষ্ণনাথের ইচ্ছা অনুসারে দেশ ও বিদেশ জুড়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারে তাঁর বিধবা পত্নী মহারানী কাশীশ্বরী ও ভাগ্নে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কোনও কার্পণ্য করেননি। সেই মহীয়সীর নামে ভাগ্নে মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বহরমপুরল শহরের প্রাণকেন্দ্রে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহারানি কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়’। উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৭৯ নম্বর পেয়ে সেই বিদ্যালয় থেকে এ বার জেলায় দ্বিতীয় হয়েছে দীক্ষা সরাফ।
এ বার ওই বিদ্যালয়ের ২৪৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৪৫ জনই উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ২৩০ জন। তার মধ্যে ৭৫ শতাংশের উপর নম্বর পেয়েছে ১৩২ জন। ৯০ শতাংশ পেয়েছে ১২ জন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক চৈতালি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গত বছর ২৪২ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৪১ জন উত্তীর্ণ হয়। ৯০ শতাংশের থেকে বেশি নম্বর পেয়েছিল নয় জন।’’
বিদ্যালয়ে কলা বিভাগের থেকে বিজ্ঞান বিভাগেরই পড়ুয়া বেশি। অনুমোদিত পদের থেকে শিক্ষিকার সংখ্যা ৯ জন কম। বছর পাঁচেক আগে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমেও উচ্চ মাধ্যমিক চালু করা হয়েছে। তবে ইংরেজি মাধ্যমের জন্য চার জন শিক্ষিকার পদ অনুমোদন হলেও গত পাঁচ বছরে একজনও নিয়োগ হয়নি। তা হলে সাফল্যের পিছনে গূঢ় রহস্য কী? চৈতালিদেবী বলেন, ‘‘এই কৃতিত্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের।’’ ৯৫.৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে এ বার জেলায় দ্বিতীয় হয়ে সেই শিক্ষিকাদের মান রেখেছেন ছাত্রী দীক্ষা।
রামকৃষ্ণ মিশন, সারগাছি
১৮৯৭ সাল। গঙ্গার পাড় ধরে স্বামী অখণ্ডানন্দ পাঁয়ে হেঁটে চলেছেন হিমালয়ের দিকে। রেজিনগরের কাছে দুর্ভিক্ষপীড়িত বালক-বালিকার দুর্দশা দেখে কাতর হয়ে পড়লেন। মানবসেবায় মন সঁপে দিতে মন টানছে। কিন্তু কর্তব্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। বিস্তারিত জানিয়ে স্বামী বিবেকানন্দকে চিঠি লিখলেন। জবাব এল ‘জীবসেবায় শিবসেবা’। সেই অনুমতি পেয়ে বেলডাঙার মহুলায় জনা কয়েক হিন্দু-মুসলমান দুঃস্থ বালক নিয়ে গড়লেন রামকৃষ্ণ মিশনের ‘প্রথম’ আশ্রম। কিছু দিন পর ভাবতার হাজিদের ‘দান’ করা সারগাছিতে একলপ্তে বিশাল জমিতে স্থান্তরিত হল সারগাছি মিশন ও আশ্রম। সেই মিশনের ছাত্র অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার জেলায় উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৪৮০।
বেলডাঙার কেদারমাটির বাসিন্দা অয়নের বাবা অমল বন্দ্যোপাধ্যায় পেট্রলপাম্পের কর্মী। অয়ন তিন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছে। তার কথায় ‘‘স্কুল না থাকলে ৭-৮ ঘণ্টা ও স্কুল থাকলে ৪-৫ ঘণ্টা পড়তাম। পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়েছি। সে বলে, ‘‘স্কুলের সব শিক্ষকই প্রচুর সাহায্য করেছেন। স্কুলের গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্রেরও সাহায্য পেয়েছি।’’ অয়ন-সহ এ বছরের ৮১ জন পরীক্ষার্থীই সফল হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭৭ জন প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। স্টার পেয়েছে ৫০ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। গত বছর ৯৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে ৭৬ জন। তার মধ্যে স্টার ২০ জন।
ওই মিশন থেকে গত বছরই প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। এ বার দ্বিতীয় বছর। প্রথম থেকেই সাফল্যের নিদর্শন রেখেছে এই আশ্রম। তার নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রধান শিক্ষক স্বামী তপোনিষ্ঠানন্দ বলেন, ‘‘ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। গরিব মেধাবীদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়। গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র থেকে পড়ুয়ার বিশেষ উপকার পেয়ে থাকে।’’ সে কথা মানছে এ বারে কেদারমাটি ও সারগাছি মিশনের উজ্জ্বল মুখ মুখচোরা অয়ন।