খোলেনি ঝাঁপ। নিজস্ব চিত্র
এক বছর আগেও দোকানে সাজিয়ে রাখা হত আতসবাজি। আর, আনাচে-কানাচে চলত শব্দবাজির কারবার। বাজি কিনতে দোকানে-দোকানে উপচে পড়ত ভিড়। এ বার যেন ভাঙা হাট সেই গাংনাপুর।
প্রতি বারই দুর্গাপুজোর আগে থেকে রমরমিয়ে ব্যবসা শুরু হয়ে যায় নদিয়ার প্রধান বাজি কারখানা এলাকা গাংনাপুরে। কালীপুজো পার করে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত কেনাবেচা চলে। স্থানীয় ক্রেতাদের পাশাপাশি দু’চাকা-চারচাকা গাড়িতে বাইরের লোকজনও এসে ভিড় জমান। সারা বছরই টুকটাক ব্যবসা চলে। কিন্তু এই মরসুমে দোকানের সামনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করা দুষ্কর হয়।
এ বার ছবিটা পুরো উল্টো।
কালীপুজোর মাত্র তিন দিন আগে, শনিবারও সব সুনসান। দেখলে মনে হবে, কিছু ক্ষণ আগেই বড় কোনও ঘটনা ঘটে গিয়েছে। বাজির সব দোকান বন্ধ। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে না।
একই অবস্থা রেললাইনের ধারে ঝুপড়িগুলোতেও। সেখানকার বেশির মহিলাই ওই সব কারখানা থেকে মশলা নিয়ে এসে বাড়িতে বসে বাজি তৈরি করতেন। কারখানা সব বন্ধ থাকায় তাঁদেরও কাজকর্ম প্রায় লাটে উঠেছে। উঁকিঝুঁকি দিয়েও সে ভাবে কাউকে নজরে পড়ে না। তবে বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, দু’একটি বাড়ি থেকে সামান্য কিছু বাজি বিক্রি হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক মহিলা বলেন, “ওই কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটার আগে কয়েকটি বাড়িতে বাজি তৈরি হচ্ছিল। তারই কিছু আড়াল থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। দু’একটা দোকানও আড়ালে বাজি বিক্রি করছে।’’
বছর চল্লিশ আগে রানাঘাট ২ ব্লকের দেবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের গাংনাপুরের প্রথম বাজি কারখানা তৈরি হয়। ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় পরে কারখানর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখান থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকা তো বটেই, জেলার বাইরেও পাইকারি হারে বাজি যায়। স্থানীয় বাসিন্দা কমল বিশ্বাস বলেন, “পুজোর আগে থেকে গাংনাপুর স্টেশনে এত ভিড় হত যে ওঠানামা করা যেত না। বাইরে থেকে কত লোক যে বাজি কিনতে আসত!” এ বার সব ফাঁকা-ফাঁকা।
তার কারণ গত ১৬ সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনা। সে দিন গাংনাপুরে একটি বাজি কারখানায় তুবড়ির মশলায় আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। মারা যান কারখানার মালিক মিঠু মণ্ডল ও কর্মী রঞ্জিত বিশ্বাস। এ দিন গিয়ে দেখা গেল, মালিকের বাড়ি তালাবন্ধ রয়েছে। নীচের দোকান ঘরগুলোরও একই অবস্থা।
রানাঘাটের মহকুমাশাসক মনীষ বর্মা বলেন, “ওই দুর্ঘটনার পরে হানা দিয়ে প্রায় ১০ কুইন্টাল বাজি আটক করা হয়েছিল। সেই বাজি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। অবৈধ বাজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে।” গাংনাপুরে নানা রকম বাজি তৈরি তো হতই। এ ছাড়াও, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা হাওড়া থেকে বাজি নিয়ে এসেও বিক্রি করা হত। এখন তা-ও বন্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মালিক জানান, দস্তুর মতো পুজোর আগে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন কারখানার মালিককে টাকা দেওয়া হয়েছিল। ১০ লক্ষ টাকা দিলে মালিকেরা ২০ লক্ষ টাকার বাজি দিত। পুজোর জন্য সে ভাবে বাজির বরাত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সবই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এখন ঋণ শোধ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওই কারখানা মালিকের কথায়, ‘‘অনেকেই বাজির জন্য ফোন করছে। তাদের পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, ‘বাজি নেই। দিতে পারব না।’ তারা অন্য জায়গা থেকে বাজি কিনছে। এ বার ব্যবসা পুরো শেষ। এই ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যুক্ত পাঁচ হাজার মানুষ বিপদে রয়েছেন।”