নাতনির অন্নপ্রাশনে কী হবে, নিরামিষ না আমিষ—তাই নিয়ে শুরু হয়েছিল দড়ি টানাটানি। শেষে নিরামিষের পক্ষেই সায় দিয়েছিলেন দাদু সঞ্জয় সাহা। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত পদ তো ছিলই। তাতে বাড়তি একটি পদ যোগ করেছিলেন সঞ্জয়। নিমন্ত্রিতদের খাইয়েছিলেন এঁচোড়ের ডালনা।
আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্ব চিরদিনের। কিন্তু ভাগাড় কাণ্ডের পর অতি বড় আমিষাশীও পিছু হটেছেন। নিমন্ত্রণকর্তারাও ভরসা পাচ্ছেন না নিমন্ত্রিতদের পাতে মাছ-মাংস দিতে। সঞ্জয়বাবুর গলাতেও সেই সুর, “চারদিকে যা শুনছি তাতে লোকজনকে মাছ-মাংস খাওয়াতে ভরসা পেলাম না। আর নিরামিষের আয়োজন যখন হল তখন এঁচোড় থাকবে না তা আবার হয় নাকি!”
ভাগাড় কাণ্ডের জের এখনও মিলিয়ে যায়নি। তাই ‘কপাল পুড়েছে’ পাঁঠার। একই কারণে কদর বেড়েছে ‘গাছপাঠা’র— মত খাদ্য রসিকদের।
হোটেল রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারতে যা খবর মিলছে, তাতে ভোজের পাতে এখন এঁচোড়েরই রমরমা। এঁচোড়-চিংড়ি তো রয়েছেই পাশাপাশি এঁচোড় কোপ্তা, এঁচোড় কষা, মুগ এঁচোড়ের মতো পদের চাহিদা বেড়েছে। ভোজন রসিকেরা জানাচ্ছেন, তেমন রাঁধুনির হাতে পড়লে ‘গাছপাঁঠার’ কচিপাঁঠার থেকে কোনও অংশে কম যায় না।
কিন্তু খরা জ্যৈষ্ঠে এঁচোড়ের পেকে কাঁঠাল হয়ে ওঠার সময়। পোড় খাওয়া রাঁধুনিরা অনেকেই এ সময়ে এঁচোড়ের পদ পছন্দ করেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘এ সময়ের এঁচোড়, চৈতালি এঁচোড়ের মতো মায়া ভোজের পাতে তেমন দেখাতে পারে না।’’ কিন্তু তা আর শুনছে কে! নিমন্ত্রণকর্তারাই যে এঁচোড়েই মজেছেন।
বহরমপুরের স্বর্ণময়ী বাজারের আনাজ বিক্রেতা মনোজ মণ্ডল যেমন জানাচ্ছেন, এখন এঁচোড় ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও সেই ফাল্গুন-চৈত্রের মতো ‘কুষি’ এঁচোড় পাওয়া দুষ্কর। গোরাবাজারে আনাজের পাইকার বুদ্ধদেব দলুইয়েরও একই মত।
মুর্শিদাবাদের এই ছবিটাই কমবেশি একই রকম নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, করিমপুর, রানাঘাট বাজারে। ১৫-১৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে দু’তিন কেজি ওজনের এঁচোড়। নবদ্বীপ বড় বাজারের বিক্রেতা রাজু বিশ্বাস বলেন, “ক্যাটারিংয়ের লোকজন যে জিনিস ওঁরা চাইছেন তা এখন খুব বেশি পাচ্ছি না। পেলেও তার দাম অনেক।”
তাতে অবশ্য পরোয়া নেই কারও। নবদ্বীপের এক ক্যাটারিং ব্যবসায়ী নিতাই বসাক যেমন বলেন, “এঁচোড়ের কোপ্তা বা মুগ এঁচোড়ের মতো পদ মেনুতে রাখতে হচ্ছেই।”
কিন্তু কেন এই এঁচোড় প্রেম?
জবাবে অনেকেই গরমের দোহাই দিচ্ছেন। বলছেন বটে চড়া গরমের ঝাল মশলাদার মাছ-মাংস নাই বা হলো খাওয়া। কিন্তু মনের কোণে অন্য একটা ভয়ও কি উঁকি দিচ্ছে না? যদিও বহরমপুর সুপার মার্কেটের হোটেল মালিক অরিন্দম মণ্ডলও জানাচ্ছেন, “ভাগাড় কাণ্ডের ছায়া এখানে তেমন নেই। তবে এঁচোড়ের চাহিদা যে বেড়েছে এটা সত্যি।”
উল্টো কথা শোনা গেল বানজেটিয়ার আইটিআই মোড়ের এক হোটেলের তরফে নন্দন সরকারের মুখে। তিনি বললেন “পচা মাংসের প্রভাব পড়েছে তো বটেই। লোকে তাই এঁচোড়ই বেশি খাচ্ছেন।”
একপ্লেট এঁচোড়ের তরকারি সঙ্গে পাঁচটা রুটি। পঞ্চাশ টাকায় চুটিয়ে বিক্রি করছেন নন্দনবাবুরা।