চরযাপন। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
নৌকার অপেক্ষায় পদ্মার শাখা নদীর পাড়ে মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছেন জলঙ্গির পরাশপুর চরের বৃদ্ধ জালাল মণ্ডল। এনআরসি নিয়ে কথা পাড়াতেই ঝাঁঝিয়ে উঠছেন, ‘‘কিসের এনআরসি, আমাদের উপরে এক যুগ আগেই নেমে এসেছে এনআরসি! এখন ভিটেটা পদ্মা ধুয়ে নিয়ে গেছে তখন থেকে আমরা পরবাসে, বুঝলেন!’’
যাঁরা দেশে থেকেও দেশের কোনও সুবিধা পান না, যাঁদের দু’বেলা প্রমাণ দিতে হয় তাঁরা ভারতীয় তাঁরা এনআরসি’র ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন! এক বুক ক্ষোভ নিয়ে এমনই ভাবছেন চরের মানুষ। তাঁদের কথায়, ‘‘যাঁদের সব হারিয়ে গেছে তাঁদের আর হারানোর ভয় কিসের?’’ তবে, আদতে কি মনের কথা সেটাই, রানিনগরের চর দুর্গাপুর এলাকার হারান মণ্ডল আতঙ্কে আছেন পদ্মার গ্রাসে নতুন করে ভিটে হারানোর। তাঁর কথায়, ‘‘এক বার নয়, তিন-তিন বার ভিটে হারা হয়েছি আমরা। একবার ওপার দেশ থেকে ভিটে ছাড়া হয়েছি। পদ্মা দু’বার খেয়েছে ভিটে। এখন সরকারের দেওয়া কাঠা দেড়েক জমিতে ভিটে গেড়ে মাথা গুঁজে আছি। এটা ছাড়তে হলে যাব কোথায়, বলুন দেখি!’’
এনআরসি হলে সেটাও ছেড়ে চলে যেতে হবে নাকি, ভিটে হারানোর নতুন আতঙ্ক হারানের চোখে মুখে। বিড় বিড় করে বলছেন, ‘‘আর পারব না। এ বার ভিটে ছাড়ার আগেই যেন শ্মশানে ঠাঁই হয়।’’
কেবল হারানো নয়, গোটা চর জুড়েই যেন একটা শ্মশানের শান্তি। কেউ বলছেন, বেঁচে থাকার স্বাদটাই হারিয়ে ফেলেছেন, কেউ আবার বলছে ‘মরলে এখানেই মরব’। জলঙ্গির চর পরাশপুরের সেলিম রেজা বলেছেন, ‘‘এমনিতেই ঝড় বৃষ্টি আর বাংলাদেশিদের আতঙ্কে থাকি। বিএসএফ আমাদের দু’বেলার ভয়। তার পর এনআরসি আতঙ্কটা জমাট বাঁধছে বুকে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি।’’
ভাঙনে ভিটের পাশাপাশি পদ্মা খেয়েছে দলিল থেকে যাবতীয় নথি। ফলে এখন নথিপত্র জোগাড় করতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে সরকারি অফিসে। চরের গ্রাম থেকে মোটা টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে দিনভর বিডিও অফিস পঞ্চায়েত ঘুরে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। চরের বাসিন্দাদের দাবি, সব হারিয়ে চরের বালিয়াড়িতে খড়কুটো দিয়ে নতুন ঠিকানা বসিয়েছেন তাঁরা, আর সেই ‘নেই গ্রামে’ ছেলেমেয়ে নিয়ে আবারও একটু একটু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে আবারও এনআরসির থাবা পড়েছে তাঁদের মনে!