দিনেদুপুরে এ ভাবেই প্রকাশ্যে উঠে যাচ্ছে বালি। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
লুকোচুরির বালাইটুকু নেই। বৈধ অনুমতি ছাড়াই দু’দুটি জেসিবি মেশিন দিয়ে দিনের আলোয় অবাধে তোলা হচ্ছে পদ্মার চরের মাটি। এক দিন দু’দিন নয়, মাসখানেক ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে অবৈধ ব্যবসা!
সুতির লক্ষ্মীপুর, রঘুনাথগঞ্জের গিরিয়া-সেকেন্দ্রার কাছে পদ্মায় এখন জল নেই। সেই শুকনো খটখটে পদ্মার গর্ভে রীতিমতো রাস্তা বানিয়ে নেমে পড়েছে ট্রাক্টর-লরি। ট্রাক্টটর প্রতি বালি মাটি বিকোচ্ছে ৭০০ টাকায়। লরি প্রতি দাম দেড় হাজার। প্রায় তিনশো লরিতে সেই মাটি পৌঁছে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকার ইটভাটায়।
অথচ, পদ্মাপাড়ের আশপাশেই রয়েছে বিএসএফ চৌকি। মাটি ভর্তি গাড়ি যাতায়াতের পথে রয়েছে পুলিশ ক্যাম্পও। গ্রামবাসীর অভিযোগ, মাটি কাটার ঠিকা নিয়েছে যারা, তদের অধিকাংশই এলাকার দুষ্কৃতী। মাটি বহনকারী লরির ধাক্কায় ইতিমধ্যে দু’টি দুর্ঘটনাও ঘটেছে। লরি চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের। গুরুতর আহত হয়ে আরও একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে গ্রামে।
নদীর চর থেকে এ ভাবে মাটি কাটায় অন্যায় কিছু দেখছেন না ইটভাটার মালিক সমিতির কর্তারা। জঙ্গিপুর ইটভাটা মালিক সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষের যুক্তি, আমরা তো উপকারই করছি। কেমন? তাঁর যুক্তি, ‘‘চরার মাটি কাটলে নদীর বুকে খাদ গভীর হবে। নদীর জলধারণ ক্ষমতা বাড়বে। এতে ভাঙন ও বন্যার আশঙ্কা কমবে।’’ ইটভাটার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করেন, নদীগুলিতে পলি জমে জলধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। দাবি উঠেছে ড্রেজিং করার। এতে সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হবে। তা ছাড়া ড্রেজিং করা বিপুল পরিমাণ পলি নদী পাড়ে ফেলে রাখলে তা বৃষ্টির জলে ধুয়ে ফের নদীতেই পড়বে। তাঁদের মত, ‘‘সে কাজ ইটভাটা মালিকেরা বিনি পয়সায় করলে সরকারি অর্থের সাশ্রয় হবে। মাটির বিনিময়ে ভাটা মালিকদের দেওয়া রয়ালিটির টাকাও সরকারের ঘরে জমা পড়বে।’’
এমন যুক্তি শুনে শিউড়ে উঠেছেন ভাঙন প্রতিরোধ বিভাগের এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়র। তিনি বলেন, ‘‘ইটভাটা মালিকদের যুক্তি ঘোরতর বেআইনি এবং অবৈজ্ঞানিক।’’ কেমন? তাঁর কথায়, পদ্মা-গঙ্গা আন্তর্জাতিক নদী। পাশেই বাংলাদেশ। ইটভাটার মালিকেরা মাটি কাটবেন নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের সুবিধে মতো জায়গা থেকে। আর সরকারি ভাবে ড্রেজিং হবে নদী ও লোকালয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে। ড্রেজিং করার বিশেষজ্ঞ কোম্পানিও রয়েছে। তারা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ওই কাজ করবেন। দু’টোর মধ্যে গুরুতর তফাৎ রয়েছে।
ইটভাটা মালিকদের অবৈধ ভাবে বালিমাটি তোলার ফলে কী সমস্যা হতে পারে? ওই ইঞ্জিনিয়রের কথায়, এর ফলে শুধু নদী গর্ভের ক্ষতি হবে না। নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হতে পারে। অবিলম্বে অবৈধ ভাবে মাটি কাটা বন্ধ করা উচিত প্রশাসনের, বলছেন তিনি।
ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জঙ্গিপুরের মহকুমা আধিকারিক উত্তমকুমার দাস অবশ্য পদ্মার বুক থেকে মাটি কাটার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন। প্রায় মাস খানেক ধরে প্রকাশ্যে মাটি কাটা চলছে, আর তিনি বলছেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও খবর নেই।’’ তবে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও তিনি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, কোনও নদী থেকেই এ ভাবে সরকারি অনুমতি ছাড়া মাটি কাটা যায় না। আমি দুটি ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অফিসারদের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠাচ্ছি। এবং মাটি কাটা বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছি।
ইটভাটা মালিকদের অবশ্য দাবি, রাজ্য সেচ দফতর থেকে তাঁদের মাটি কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধ বিভাগের মুর্শিদাবাদ বিভাগের বাস্তুকার জয়ন্ত দাস মানছেন, ‘‘বিভাগীয় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে চরার মধ্যে থেকে মাটি কাটা যেতে পারে। সেই কারণে প্লট নম্বর উল্লেখ করে নদীর চরার মাঝ বরাবর মাটি কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে দু’একজনকে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে কোনও মাটি কাটা যাবে না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘দক্ষিণ পাড় বরাবর জলস্রোত রয়েছে। তার পাশে মাটি কাটলে ভাঙন বাড়বে। তবু কিছু অভিযোগ এসেছে। খতিয়ে দেখে রঘুনাথগঞ্জের সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়রের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে।’’
উঠছে এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্নও। জেলা পরিষদের প্রাক্তন পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সোমনাথ সিংহরায়ের অভিযোগ, ‘‘ভাগীরথীর চরা থেকে ৩৬৩৭ নম্বর দাগ (জেওএল নম্বর ১৪) থেকে ১৫ দিনের জন্যে ৫০ হাজার কিউবিক ফুট মাটি কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানি। কিন্তু মাটি কাটা হচ্ছে পদ্মার চর থেকে! আসলে সবটাই হচ্ছে বেআইনি ভাবে।’’ তাঁর প্রশ্ন, এই নদী ফরাক্কা ব্যারাজের নিয়ন্ত্রণে। অ্যাফ্লেক্স বাঁধ থেকে পদ্মার বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত মাটি কাটা বহু আগেই নিষিদ্ধ করেছেন তারা। তা হলে রাজ্য সেচ দফতর সেখানে মাটি কাটার অনুমতি দিচ্ছে কী করে? ফরাক্কার জেনারেল ম্যানেজার সৌমিত্র হালদার বলেন, ‘‘গঙ্গা, পদ্মা থেকে মাটি কাটা আইনসিদ্ধ নয়। তবু কার অনুমতিতে কে কী করছে বলতে পারব না!’’
চাপানউতোর চলছে। অবাধে চলছে মাটি কাটাও! বাড়ছে ক্ষোভ। স্থানীয় সেই বাসিন্দারা চেয়ে প্রশাসনের তৎপরতার দিকে!