উড়ছে বাস, ঘামছে যাত্রী

কন্ডাক্টরের মুখের রেখায় জটিল পাটিগণিত। একমনে টিকিট কেটে চলেছেন। খুচরো ফেরত দিতে না পারলে টিকিটের পিছনে টাকার অঙ্ক লিখে দিচ্ছে সে।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৭ ০৮:০০
Share:

ছাড়লেই উড়বে! ছাড়লেই উড়বে! বাসের দরজায় থাপ্পড় মেরে নাগাড়ে মন্ত্রের মতো বলে চলেছে হেল্পার।

Advertisement

‘কী দাদা, বাস টানবে তো? নাকি ছাড়ার পরেই ঝিমোবে?’

দাঁত বের করেন রোগা চেহারার বাস কর্মী বলছেন—

Advertisement

‘কী যে বলেন! গাড়ির কাচে কী লেখা, সুপার গাড়ি উড়বে গো!’

কন্ডাক্টরের মুখের রেখায় জটিল পাটিগণিত। একমনে টিকিট কেটে চলেছেন। খুচরো ফেরত দিতে না পারলে টিকিটের পিছনে টাকার অঙ্ক লিখে দিচ্ছে সে। নামার আগে ঠিক হাতের মুঠোয় ঠুসে দেবে পাওনা।

চিৎকারটা ফের ঘুরতে থাকে— ছাড়লেই উড়বে, ছাড়লেই ...। যাত্রীরা নড়েচড়ে বসেন। ‘পাইলট’ লেখা দরজা খুলে স্টিয়ারিং ধরেন চালক। গর্জে ওঠে ইঞ্জিন। প্রথমে হালকা ঝাঁকুনি এবং তার পর বিকট শব্দ করে বাস্তবিকই ছুটতে থাকে বাস।

যে লাইনে ট্রেন নেই, সে লাইনে বাসই যে শেষ কথা তা তরণীপুর, নিশ্চিন্তিপুরের মানুষ কি জানে না! বিকল্প না থাকায় অতএব সে নিজের মতো কখনও ওড়ে, কখনও হাঁটে, কখনও আবার গায়ের ব্যাথা-বেদনা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েই থাকে। গতির সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ বদলে যায় যাত্রীদেরও।

—‘আরে ও দাদা, এ বাস নাকি সুপার? সব জায়গাতেই তো থামছে দেখছি!’ কেউ বলে —‘পিছনে আর একটি বাস না আসা পর্যন্ত এর হুঁশ ফিরবে না।’ আর চালক? ঘণ্টি বা খালাসির হাতের আওয়াজ ছাড়া কোনও কথাই তাঁর কানে পৌঁছয় না। ‘শুভ যাত্রা’ লিখে নদিয়া-মুর্শিদাবাদে এ ভাবেই চলে বাসযাত্রা।

ঠিক সে ভাবেই তো মঙ্গলবার সকালে কৃষ্ণনগর থেকে বাসটা ছেড়েছিল পলাশিপাড়ার দিকে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে তেহট্টের গলাকাটা মাঠ এলাকায় হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল নয়ানজুলিতে। মৃত ৯, জখম ৮৩। এবং চালক পলাতক।

প্রতিদিন ঘটে চলা বাস দুর্ঘটনার যোগফল আরও একটা বাড়ল! আর কী হল? ন’টি পরিবার তছনছ হয়ে গেল। কেউ অনাথ হল। ‘আমরা বাসে উঠে পড়েছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব’ বলেও মৃত আত্মীয়কে দেখতে যাওয়ার আগেই নিথর হয়ে গেলেন মা-মেয়ে। সেই নয়ানজুলিতে সেঁদিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক নিয়ে এখনও হাসপাতালে কত জন। চালককে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ধরব তো বটেই। পালিয়ে যাবে কোথায়?’’

যাত্রী থেকে পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী থেকে পথচারী সকলেই দুষছেন বাস চালককে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ও অভিযোগের শেষ নেই।

‘কেন রেষারেষি করছিল?’

‘কেন যাত্রীদের কথা শোনেনি?’

‘কেন আরও সতর্ক হয়ে বাস চালাচ্ছিল না?’

‘এতগুলো মৃত্যুর দায় কে নেবে?’

সে হয়তো ধরা পড়বে। শাস্তিও জুটবে। শুধু তেহট্ট কেন, যে কোনও দুর্ঘটনার পরেই এই প্রশ্নগুলো ওঠে। কিঞ্চিৎ শাস্তিও হয়, দোষ তো তারই! তারই, শুধুই তার?

ক্ষয়ে যেতে যেতে টাক পড়ে যাওয়া টায়ার, লজঝড়ে ‘বডি’, লাট্টুর মতো ঘুরতে থাকা স্টিয়ারিং নিয়ে কেন বাস চালায় লোকটা, সে প্রশ্নের খোঁজ কে রাখে বলুন তো? প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় অন্য এক বাস চালক। প্রশ্নটা উঠতই না তিনি না করলে। কিন্তু উল্টো মুড়ো ঘুরলে এ প্রশ্নগুলোও তো ওঠার কথা, কেন মাইলের পর মাইল মাসের পর মাস, বেহাল থাকে রাস্তা?

কেন রেষারেষি দেখেও চুপ করে থাকে ট্রাফিক পুলিশ? কেন সতর্ক হয় না পথচারী? কী সের জোরে ‘আনফিট’ বাসগুলো ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেয়ে দুড়দাঢ় নেমে পড়ে রাস্তায়?

প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু সদুত্তর কখনওই মেলে না।

চিত্র পরিচালক নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সেই ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? একটি বেসরকারি বাসের ধাক্কায় মারা যায় একটি শিশু। কার দোষে মারা গেল সে? জনতা মারধর করে চালককে পুলিশে দিল। ট্রিপ নিয়ে রেষারেষি, ওভারটেকিং, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা — এ সব দোষ চালকের ছিল। কিন্তু শিশুটির মৃত্যু কি শুধু সেই কারণে হয়েছিল? না। তা হলে? মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পথচারীর দোষ’। কিন্তু বাসটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। ব্রেকও ঠিক কাজ করছিল না। বাস মালিক জানতেন। কিন্তু তিনি গা করেননি।

বাস মালিক অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তা বলেন, ‘‘ভাবতে পারেন, একটা বাস বসলে কত জনের পেটে টান পড়বে, মানুষেরই বা কী হবে!’’ কী হবে তার উত্তর অহরহ পাচ্ছি। কিন্তু সরকারি পরিবহণ দফতর? বাসের হাল জেনেও তারা নির্বিকার ছাড়পত্র দিয়েছিল। তা হলে? আসলে প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর ততটা নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement