অবহেলায় পড়ে কুমার হস্টেল, চুরি যাচ্ছে ইতিহাস

এক সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের আস্তানা ছিল এই বাড়ি। পরবর্তী কালে বিপ্লবীদের ঘাঁটিও ছিল এটা। অর্থাৎ, এ বাড়ির পরতে পরতে ইতিহাস। ইতিহাস বললে ভুল বলা হয়। এ যেন এক বিপন্ন ইতিহাস। বহরমপুরের এই বাড়ির নাম এক সময় ছিল ‘ওল্ড সার্কিট হাউস’। পরবর্তীকেলে এই বাড়ি কলেজকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাম হয়েছিল কুমার হস্টেল।

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৬ ০৭:৩৬
Share:

কুমার হস্টেল যেন হানাবাড়ি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

এক সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের আস্তানা ছিল এই বাড়ি। পরবর্তী কালে বিপ্লবীদের ঘাঁটিও ছিল এটা। অর্থাৎ, এ বাড়ির পরতে পরতে ইতিহাস। ইতিহাস বললে ভুল বলা হয়। এ যেন এক বিপন্ন ইতিহাস।

Advertisement

বহরমপুরের এই বাড়ির নাম এক সময় ছিল ‘ওল্ড সার্কিট হাউস’। পরবর্তীকেলে এই বাড়ি কলেজকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাম হয়েছিল কুমার হস্টেল। ইতিহাসের সেই বাড়িতে এখন সময় আর অযত্নের থাবা। ঝড়ে পড়ে ইট-বালি-সুরকির সঙ্গে সঙ্গে শহর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই ইতিহাস। হেলদোল নেই প্রশাসনের।

কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ওই হস্টেল হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের অন্যতম ঘাঁটি। সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন ওই ঐতিহাসিক পুরাসম্পদ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। যেন ভূতবাংলো। সমাজবিরোধীদের আশ্রয়স্থলও বটে।

Advertisement

বহরমপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে ২৩ বিঘা জমিতে প্রায় তিন দশক আগে গড়ে তোলা হয় তিন তলা বিশাল প্রাসাদ। নাম নতুন কুমার হস্টেল। তার অনতিদূরে, মাঠের মাঝখানে বিলুপ্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকা প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন দোতলা ভবনটির আজকের নাম পুরাতন কুমার হস্টেল।

১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেটি ছাত্রাবাস হিসাবে ব্যবহৃতও হয়েছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন সোমেশ রায়। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, ওই বাড়িটা একদা সার্কিট হাউস ছিল। সেখানে থেকেছেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ও রবার্ট ক্লাইভ। সেই কারণে ঐতিহাসিক ওই ভবনকে ‘পুরাতন সার্কিট হাউস’ বলা হয়। পরে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ারের পশ্চিম প্রান্তে গড়ে তোলা হয় নতুন সার্কিট হাউস। ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অবিভক্ত বাংলার অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণনাথ কলেজ। সোমেশবাবু বলেন, ‘‘কলেজ প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছর পর পুরাতন সার্কিট হাউসটি কলেজকে দেন সুবে বাংলার তৎকালীন অধিকর্তা বিডন সাহেব।’’ পুরাতন সার্কিট হাউস কৃষ্ণনাথ কলজের হস্টেলে রূপান্তরিত হয়।

১৮১৫ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত ওই কলেজের ছাত্র ছিলেন সূর্য সেন। থাকতেন হস্টেলে। ওই সময় অনেক ছাত্র ও শিক্ষক স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে কলেজের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ইতিহাসের আকর গ্রন্থ ‘কৃষ্ণনাথ কলেজ সেন্টিনারি ভলিউম’।

অগ্নিযুগের বিপ্লবী কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র যোগেন্দ্রনাথ দে সরকার ওই বইয়ে ‘বিপ্লবের সাধনায় কৃষ্ণনাথ কলেজ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের নেতা সূর্য সেন, ১৯৩০ সালে বিপ্লবের ইতিহাসে কৃষ্ণনাথ কলেজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া দিল। এই বৎসরে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠণ এক স্মরণীয় ঘটনা। সূর্য সেন ছিল ইহার সর্বাধিনায়ক।’’

সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে সেই ভবন আজ ধ্বংসের পথে। ওই ঐতিহ্য সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য রাজ্য হেরিটেজ কমিটিকে বহু বার আবেদন করেও লাভ হয়নি। আক্ষেপের সঙ্গেই অনালোকিত একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোমেশবাবু।

১৮৪৪ সাল। তখনও ভারতবর্ষে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেননি কেউ। সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ডিরোজিওর ভাবশিষ্য কাশিমবাজারের রাজা ২২ বছরের কৃষ্ণনাথ। ১৮৪৪ সালে আত্মঘাতী হন তিনি। কাশিমবাজারের বানজেটিয়ায় বিজ্ঞান-দর্শন-চিকিৎসা শাস্ত্র-ভাষা শিক্ষার জন্য অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে কৃষ্ণনাথ আত্মঘাতী হওয়ার আগের দিন তাঁর সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন।

মৃত্যুর পর মামলার রায়ে সেই উইল বাতিল হয়ে যায়। তবে প্রয়াত রাজার স্বপ্ন সফল করতে ইংরেজরা যে পদক্ষেপ করেছিলেন তার সমর্থন মেলে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দেওয়া তথ্যে। সোমেশবাবু জানিয়েছেন, ‘‘লন্ডন মিউজিয়ামে রক্ষিত ১৮৫১ সালের মানচিত্রে পুরনো সার্কিট হাউস ও লাগোয়া বিশাল এলাকাকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’’

কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ কল্যাণাক্ষ ঘোষ বলেন, ‘‘সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের নির্দেশে ২০১৫ সালের গোড়ার দিকে একটি সংস্থা সরজমিনে ওই হস্টেল পরিদর্শন ও সমীক্ষা করেছে। তারপর অবশ্য কাজ এগোয়নি।’’ কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে পুরনো কুমার হস্টেল সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবি জানিয়েছি। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রও তাঁকে দিয়েছি।’’

কালের গর্ভে কি বিলীন হবে ঐতিহাসিক কুমার হস্টেল? জবাব রয়ছে ভবিষ্যতের গর্ভে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement