জীর্ণ আস্তাবলের দায় নেবে কে, জোর তরজা মুর্শিদাবাদে

এক সময় সেখানে বাঁধা থাকত নবাবের ঘোড়া। সারাদিনের খাটাখাটনির পর ‘চানা’ খেয়ে আরামে চোখ বুজত নবাবের ঘোড়াগুলি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share:

‘বিপজ্জনক’ আস্তাবলের নীচেই বসেছে সব্জিবাজার।— নিজস্ব চিত্র

এক সময় সেখানে বাঁধা থাকত নবাবের ঘোড়া। সারাদিনের খাটাখাটনির পর ‘চানা’ খেয়ে আরামে চোখ বুজত নবাবের ঘোড়াগুলি।

Advertisement

এখন সেই নবাব নেই। কিন্তু থেকে গিয়েছে আস্তাবল। আর তাকে ঘিরে গোল বেঁধেছে মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ এবং মুর্শিদাবাদ পুরসভার মধ্যে।

নবাবি আমলের আস্তাবলে এখন সব্জি বাজার বসে। সেই বাজার সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছে পুরসভাকে। কিন্তু এখনই ওই বাজার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া কোনও ভাবে সম্ভব নয় বলে পুর-কর্তৃপক্ষ পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে। সেই সঙ্গে দ্রুত ওই ভবন সংস্কারের দাবিও জানিয়েছে তারা। এ নিয়ে মে মাস থেকে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকটি চিঠি চালাচালি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গত ৩০ জুন মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ যে চিঠি দিয়েছে, তাতে বাজার সরিয়ে না নেওয়ার ফলে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তার দায় পুরভাকেই নিতে হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এতে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে।

Advertisement

তৎকালীন নাজিম ফেরাদুন জাঁ (১৮২৪-১৮৩৮)-এর আমলে ওই আস্তাবল নির্মিত হয়। খরচ হয় ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৫৯২ টাকা। মুর্শিদাবাদ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আস্তাবল থেকে ক্রমে ওই জায়গা আস্তাবল মোড় নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আস্তাবলে এখন সব্জি বাজার বসে। রয়েছে সিমেন্ট, চিনি, রেশনদ্রব্য, মিড-ডে মিলের খাদ্যশস্য ও সব্জির গুদামঘরও। রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং কো-অর্ডিনেশন কমিটির কার্যালয়। ব্যবসায়ী ও ক্রেতা মিলিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয় ওই আস্তাবলে।

এখন দু’শো বছরের পুরনো ওই আস্তাবল সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোনও হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। বর্তমানে আস্তাবল মুর্শিদাবাদ এস্টেটের অধীনে। সম্প্রতি ভবনটি ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করে বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নতুন সব্জি বাজার গড়ে না ওঠায় আস্তাবল চত্বর ছেড়ে যেতে পারছেন না সব্জি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, বট, পাকুড়, নিম, অশত্থ গাছের শিকড় ছাদ ও দেওয়াল আঁকড়ে উপড়ে ফেলেছে ইঁট-কাঠের পুরু আচ্ছাদন। বছর কয়েক আগে রাতের বেলায় একটি কড়িবর্গা খুলে পড়ে। রাতে ঘটেছিল বলে রক্ষে। তাই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। মুর্শিদাবাদ এস্টেট আগে তাঁদের থেকে খাজনা আদায় করত। কিন্তু সংস্কার না করার ফলে তাঁরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন।

সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘জমি সমস্যার কারণে সব্জি বাজার করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর আগে আস্তাবলের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি জায়গা বাছা হয়। কিন্তু পরে ওই জায়গা দখল করে বসতি গড়ে ওঠে।’’ তিনি জানান, এখন পাঁচরাহা মোড়ে নেতাজি মার্কেট সংলগ্ন মাছের বাজারের গা-লাগোয়া জায়গায় সব্জি বাজার গড়ে যেতে পারে। ওই জায়গায় সবজি বাজার গড়ে তোলার ভাবনা ছিল তৎকালীন মন্ত্রী ছায়া ঘোষের। কিন্তু সেই সময়ে তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এখন প্রশাসন সেখানে নতুন সব্জি বাজার গড়ে দিলে সকলের সুবিধে হবে।

পুরপ্রধান বিপ্লব চক্রবর্তী জানান, রাস্তা দখল করে আগে তহবাজার বসত। এতে যানজট হত। রাস্তা দিয়ে যাতায়াতও করা যেত না। তখন ওই বাজার তুলে দেওয়া হলে ওই ব্যবসায়ীরা আস্তাবল চত্বরে সব্জির ডালা নিয়ে বসতে শুরু করেন। মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ তাঁদের থেকে খাজনা আদায়ও করত। এখন নিরাপত্তার কারণে পুর-নাগরিক ও ব্যবসায়ীরা ওই ভবন সংস্কারের দাবি জানান। মুর্শিদাবাদ এস্টেট কর্তৃপক্ষ ওই বাজার তুলে দেওয়ার কথা জানিয়ে মাস খানেক আগে আমাদের চিঠি পাঠায়। কিন্তু নতুন বাজার গড়ার মতো জমি পুরসভার হাতে নেই।

বিপ্লববাবুর অভিযোগ, ‘‘কয়েক কোটি টাকা খরচ করে রাজ্য সরকার যেখানে কৃষি বাজার করতে পারে, সেখানে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে ওই ঐতিহ্যপূর্ণ হেরিটেজ ভবন সংস্কার করতে পারবে না কেন?’’ তাঁর দাবি, অবিলম্বে ওই ভবন সংস্কার করে ব্যবসায়ীদের ও পুর-নাগরিকদের নিরপত্তার ব্যবস্থা এস্টেট কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। ওই দাবি জানিয়ে পুরপ্রধান চিঠিও পাঠায় এস্টেট কর্তৃপক্ষকে। তার পরেই এস্টেট কর্তৃপক্ষ ‘বিপজ্জনক’ ওই ভবন ভেঙে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হলে তার দায় পুরসভাকেই নিতে হবে বলে পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে জানায়।

লালবাগের মহকুমাশাসক প্রবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি শুনেছি। ওই ভবন সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। গোটা বিষয়টি আইন দফতরকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও সিদ্ধান্ত জানতে পারিনি।’’ ফলে চিঠি চালাচালি’র মধ্যেই থমকে রয়েছে বাজারকে ঘিরে মীমাংসাসূত্র! সেই সঙ্গে সাধারণ পুর-নাগরিকদের নিরপত্তার প্রশ্নটিও ঝুলে রয়েছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement