বহরমপুরের কাজী নজরুল সরণীতে উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে বালি-সুরকি।— নিজস্ব চিত্র।
দৃশ্য এক: একবার বাঁ দিকে তো একবার ডান দিকে। বর্ষায় হাড়পাজরা বেরিয়ে আসা রাস্তায় গর্তগুলো পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে চলা। তবু এ যে নেহাতই খানাখন্দ নয়, টের পাননি ধুবুলিয়ার আনন্দনগরের বাসিন্দা পবন সরকার। ব্যস, কৃষ্ণনগরের জলঙ্গি সেতুর কাছে এমনই একটা জলভর্তি গর্তে মোটরবাইকের চাকা পড়তেই, হুড়মুড়িয়ে পতন। —‘‘ভাগ্য ভাল। পিছনের লরিটা ঠিক সময়ে ব্রেক কষেছিল। না হলে বেঘোরে প্রাণ যেত সে দিন,’’ বললেন পবন।
দৃশ্য দুই: সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি। প্রায় আকাশ ভাঙার জোগাড়। ‘বাড়ি থেকে বেরিও না বাবা’, ছ’বছরের একরত্তি মেয়েটা বায়না ধরেছিল। মানা করেন স্ত্রী-ও। ‘এ বেলাটা ভাতে ভাত করে নেব। যেও না’, বলেছিলেন তিনি। তবু দুর্যোগের মধ্যেই গ্যাস সিলিন্ডার আনতে বেরিয়ে যান বহরমপুরের ইন্দ্রপ্রস্থের বাসিন্দা উজ্জ্বল সরকার। মোটরবাইকের পিছনে গ্যাস সিলিন্ডারটা বেঁধে নেন। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় পুকুর হয়ে যাওয়া খানা-খন্দ পাশ কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে টের পাননি কত বড় ফাঁদ পাতা রয়েছে। হঠাৎই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে পিচ উঠে যাওয়া রাস্তায় গর্তের মধ্যে আটকে যায় বাইকের চাকা। ঠিক তখনই পিছন থেকে দ্রুত গতিতে এসে ধাক্কা মারে লরি। ঘটনাস্থলেই মারা যান উজ্জ্বল।
বর্ষা মানেই ভারী বৃষ্টি আর একটানা বৃষ্টি মানেই বেহাল রাস্তা। পিচের চাদর উঠে গিয়ে কঙ্কালসার রাস্তার চেহারা। পথের উপরে বিছিয়ে থাকা পাথরকুচি ডেকে আনে বিপদ। একটু জোরে মোটরবাইক চালালেই পিছলে গিয়ে রাস্তায় হুড়মুড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। সব চেয়ে বিপাকে পড়েন স্কুটি আরোহীরা। স্কুটির চাকা ছোট। পিছলে পড়ে হাত-পা ভাঙা, কোনও নতুন ঘটনা নয়।
বর্ষার সবে শুরু। এর মধ্যেই বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে ট্র্যাফিক পুলিশ আইল্যান্ডের পাশে হাঁটু পর্যন্ত গর্ত হয়ে গিয়েছে। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পঞ্চাননতলা রেল গেট পর্যন্ত মধুপুর-বিষ্ণুপুর রোড জুড়ে পিচের চাদর উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের এই হাল কিংবা একের পর এক দুর্ঘটনা দেখেও নিরুত্তাপ প্রশাসন। অন্য দিকে, বহরমপুর পুরসভার বিভিন্ন বড় রাস্তার উপরে বালি-পাথর ফেলে রেখে প্রোমোটার-বাহিনী বহুতল আবাসন গড়তে ব্যস্ত। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গোটা রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে বালি। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটছে আকছার। বহরমপুরের বাসিন্দা রাখি বিশ্বাস বললেন, ‘‘রাস্তার উপরে পাথর-বালি ফেলে রাখার জন্য হাঁটাচলাই দায়। স্কুটি নিয়ে যেতে আরও ভয় করে।’’ সমাধান হবে কবে?
খানাখন্দে ভরা নতুন বাজার যাওয়ার রাস্তা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
বহরমপুর পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, ‘‘বৃষ্টির জন্য মধুপুর-বিষ্ণুপুর রোডের রাস্তার কাজ শুরু করা যাচ্ছিল না। এখন বৃষ্টি নেই। ফলে কাজ শুরু হবে।’’ তবে রাস্তার উপরে বালি-পাথর ফেলে রাখা চলবে না। সাফ কথা নীলরতনবাবুর। কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে! পুরপ্রধান বলেন, ‘‘রাস্তার মধ্যে বালি-পাথর ফেলে রেখে বাসিন্দাদের যাতায়াতে কোনও ভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা যাবে না। ওই ধরনের কোনও অভিযোগ পেলেই বালি-পাথর বাজেয়াপ্ত করা হবে।’’
নদিয়া জেলা জুড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গর্ত হয়ে। যার ফলে সমস্যায় পড়ছেন পথচারীরা। চাকদহের শিমুরালিতে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় সম্প্রতি ধস নেমেছে। যার ফলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। শান্তিপুরের গোবিন্দপুর রেলগেটের কাছেও রাস্তা খুবই খারাপ। তা ছাড়াও বাহাদুর, যুগপুর-সহ জাতীয় সড়কের বিভিন্ন জায়গায় মরনফাঁদ। কৃষ্ণনগরের পান্থতীর্থ মোড়ের কাছে রেলগেটের দু’দিকে ২-৩ ফুট বড় গর্ত হয়েছে। বৃষ্টি হলেই ছোটখাট ডোবা!
করিমপুর-মথুরাপুর রাস্তায় বাঁশবেড়িয়ার কাছে রাস্তায় বড় গর্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় ১০০ মিটার রাস্তা এতটাই খারাপ যে মাঝেমধ্যেই গাড়ি উল্টে যায়। বেথুয়াডহরি থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে। এর উপর আবার বর্ষাকালে চাষিরা মাঠ থেকে পাট কেটে এনে রাস্তার পাশে ফেলে রাখেন। বৃষ্টির জেরে সেই পাটের পাতা পচে রাস্তা পিছল হয়ে যায়। দিন কয়েক আগে এক যুবক মোটরবাইকে করে তেহট্ট ঘাট থেকে বার্নিয়া যাচ্ছিলেন। পাটের পচা পাতায় মোটরবাইকের চাকা পড়তেই দুর্ঘটনা।
—রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে।
—দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
—বালি-পাথর রাখা চলবে না।
প্রশ্নের মুখে পড়তেই এমন হাজারো প্রতিশ্রুতির কথা শোনাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা। সত্যিই কি সমস্যা মিটবে?
উত্তর মেলে না।