মারাই গেল ভোতনকাকু

সে দিন তিনিও জখম হয়েছিলেন। হাত, পাঁজর, মাথা— ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোটগুলো ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছিল। কলকাতার হাসপাতালে টানা আট দিন লড়াই করার পরে শেষতক হেরেই গিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

বিমান হাজরা

সুতি শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০০:৫৭
Share:

শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে স্কুলের শিক্ষক -পড়ুয়ারা। — নিজস্ব চিত্র

সে দিন তিনিও জখম হয়েছিলেন। হাত, পাঁজর, মাথা— ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোটগুলো ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছিল। কলকাতার হাসপাতালে টানা আট দিন লড়াই করার পরে শেষতক হেরেই গিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

যাঁর নিয়ম ভাঙার মাশুল গুনে অকালে মারা গিয়েছিল তিন-তিনটি স্কুল পড়ুয়া, সেই পুলকার চালকের পাশেই কিন্তু নির্ধ্বিদায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল ফরাক্কার ডিপিএস স্কুলের তামাম পড়ুয়া, এমনকী শিক্ষক- অভিভাবকেরাও।

তাঁর জন্য ‘সামান্য’ কিছু টাকাও তুলেছিলেন তাঁরা। শিক্ষকদের বেতনের একাংশ, অভিভাবকেরা যে যেমন পারেন’-এর পাশাপাশি পুলকারে দাপাদাপি করে স্কুলে যাওয়া পড়ুয়ারাও টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে তুলে দিয়েছিল কিছু টাকা।

Advertisement

কিন্তু তা দিয়ে আর চিকিৎসা করার সুযোগ দেননি সেই চালক। গত বৃহস্পতিবার, কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গিয়েছেন ভোতন দাস।

সোমবার, সেই ভোতনকাকুর জন্য টিফিনের পয়সা বাঁচানো পঁচিশ হাজার ছ’শো টাকাই তুলে দেওয়া হল তাঁর পরিবারের হাতে। ‘কাকু’র নামটুকুই জানত তারা। বাড়ি, কোথায়, কার গাড়ি চালায়— না, কিছুই জানা নেই। তবু সেই ড্রাইভার কাকুর চিকিৎসার জন্যই টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে ২৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছিল ফরাক্কার দিল্লি পাবলিক স্কুলের তিনটি ক্লাসের পড়ুয়ারা।

এ দিন সুতির অখ্যাত গ্রামে মানিকপুরে ছিল ভোতনের পারলৌকিক ক্রিয়া। মুন্ডিত মস্তক তাঁর বছর দশেকের ছেলে রাঙা, বাবার বাঁধানো ছবির সামনে বসে। পাশে বসে ভোতন কাকুর গাড়ির সওয়ারি অষ্টম শ্রেণির সুমি। পরিবারের এক মাত্র রোজগেরে স্বামীর ছবির দিকে চেয়ে বার বার আছড়ে পড়ছে স্ত্রী রীতা, “এ বার কী হবে, গো!’’ নাবালক ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে মায়ের দিকে।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ভোতনকাকুর গাড়ির সওয়ারিরাও। চশমার কাচ মুছলেন ডিপিএসের অধ্যক্ষ কমলেশ জয়সওয়ালও।

সেই দুর্ঘটনার খবর।

ধরা গলায় শুনিয়ে গেলেন আশ্বাস, ভোতনের স্ত্রীর জন্য একটা চাকরির যদি কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন তাঁরা।

কাকুর বাড়িতে দাঁড়িয়েই রুমালে চোখ মুছে দশম শ্রেণির কিরণদীপ মহান্তি বলছে, “সাত দিন পেরিয়ে গিয়েছে, আমরা ভেবেছিলাম ভাল হয়ে যাবে ভোতনকাকু। কে জানত ওঁর ছবির সামনে দাঁড়াতে হবে!’’ টাকাটা তুলেছিল স্কুলের অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা।

অন্য একটি পুলকারে রোজ ধুলিয়ান থেকে স্কুলে যাতায়াত করে দশম শ্রেণির আর এক ছাত্র সিদ্ধার্থ সিংহ। বলছে, “আমরা স্কুলে আসি কাকুদের গাড়িতে চড়ে। রোজ গাড়ি থেকে নামিয়ে স্কুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে স্কুলের ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করে। একটু এদিক-ওদিক হলে বকাও খেতাম। দুপুরে ফের বাড়ি ফিরতাম কাকুদের হাত ধরেই। সেই হাত ধরে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার লোকটাই এ ভাবে চলে গেল?”

এ ভাবে শোকের মুখোমুখি কখনও হয়নি অষ্টাম শ্রেণির অরিজিত দাস। সে বলছে, “দুর্ঘটনায় তিন সহপাঠীকে হারিয়েছি। তাদের পাশে দাঁড়াবার সময়টুকুও পাইনি আমরা। কাকুর পাশে থেকে চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমরা রোজ টিফিন না খেয়ে পয়সা বাঁচাতাম। বেশ কয়েকটা টাকাও জমিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও কাজে লাগল না!’’

নিতান্তই অভাবী পরিবারের ছেলে ভোতন। চার ভাই। নিজের এক আত্মীয়ের গাড়িই স্কুলের পুলকার হিসেবে ভাড়ায় চালাতেন ভোতন। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর দশ বছরের ছেলে। বৃদ্ধা বলছিলেন, ‘‘যে স্কুলের ছেলেদের পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রাণটা গেল ছেলেটার, কিন্তু সেই বাচ্চাগুলোই যে এ ভাবে দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে তা ভাবতে পারিনি! এখনও ভগবান আছেন বলে মনে হয়!’’

ফিরে যাওয়ার আগে এক অভিভাবক নিজের মনেই বলছেন, ‘‘ওই দশ বছরের বাচ্চাটাই কী ভেবেছিল, এখনও বাবার ছবির সামনে বসতে হবে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement