বিধানসভা নির্বাচনকে ‘পাখির চোখ’ করে মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় তাঁদের মন জয়ে ইফতারকে হাতিয়ার করল কংগ্রেস, তৃণমূল।
জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে প্রতিটি ব্লকের সভাপতিকে ইফতার জমায়েত করার লিখিত নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। পিছিয়ে নেই শাসক দলও। দলের যেখানে যেমন সামর্থ্য রয়েছে সেখানে ইফতারের মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন স্বয়ং। দু’টি দলই জেলায় কেন্দ্রীয় ভাবে ইফতাররের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, দলের সংখ্যালঘু সেল থেকে ইফতারের আয়োজন চলছে। সেখানে শুধুমাত্র সংখ্যালঘুরাই আমন্ত্রিত হবেন। ব্যতিক্রম শুধু সিপিএম। দলীয় নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ইফতার নিয়ে রাজনীতি করার পক্ষপাতী নন।
ভোটে জয় পেতে রাজ্যের সংখ্যালঘুরা যে বড় ‘ফ্যাক্টর’ একান্তে তা মানে সব দলই। ওয়াকিবহাল মহলের মত, সে জন্য নানা সময়ে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তৎপরতা দেখা যায় রাজনৈতিক নেতাদের। মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় এ ব্যাপারে তাঁদের বাড়তি ‘নজর’ থাকবে তা বলাইবাহুল্য। অনেকেই জানাচ্ছেন, মুর্শিদাবাদে ইফতারের রাজনীতি নতুন নয়। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জনসংযোগ বাড়াতে ইফতারের আয়োজন জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলে দীর্ঘ দিনের চল। কিন্তু তার সঙ্গে দলীয় স্ট্যাম্প, প্যাডের ব্যবহার হতে দেখা যায়নি কখনও। ইফতারের জমায়েত নিয়ে রাজনৈতিক দলের এমন লিখিত নির্দেশের কথা মনে করতে পারছেন না নেতাদের কেউই। সেই প্রেক্ষিতে এমন নির্দেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে তাঁদের মত।
কংগ্রেস নেতৃত্বেরও দাবি, এ বারই প্রথম ইফতার সমাবেশ করার দলীয় সিদ্ধান্তের কথা দলের প্যাডে লিখে ব্লকের সভাপতিদের জানানো হয়েছে। চিঠি পেয়ে রবিবার সাগরদিঘিতে ইফতারের আয়োজন করে দলের একাধিক গণসংগঠন ও ব্লক কংগ্রেস। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি বিধায়ক আবু হেনা নিজেই। ব্লক সভাপতি অলক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনের আগে বলেই এ বারের ইফতারের জমায়েত দলীয় বাঁধনে বাঁধা পড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু সংখ্যালঘু মানুষ হাজির ছিলেন সেই জমায়েতে।’’ তিনি মানছেন, ‘‘ভোটের মুখে তাঁদের সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যেই এমন কর্মসূচি।’’ পঞ্চায়েত স্তরেও ইফতার করতে উদ্যোগী হচ্ছে কংগ্রেস।
এতে অন্যায়ের কিছু দেখছেন না সুতি ১ ব্লকের কংগ্রেস সভাপতি রজত দাস। তাঁর যুক্তি, ‘‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইফতার হলে, দলীয় উদ্যোগে তা হতে অসুবিধে কোথায়?’’ ফরাক্কা ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি অমল মিশ্র জানালেন, প্রতিবার ফরাক্কায় ইফতার হয় দলীয় বিধায়ক মইনুল হকের উদ্যোগে। এ বার জেলা কংগ্রেসের ডাকে তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুতি ২ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আলফাজুদ্দিন বিশ্বাসও মানছেন, ‘‘নির্বাচনের আর আট, ন’মাস বাকি। উপলক্ষ ইফতার হলেও রাজনৈতিক বার্তা কর্মীদের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ায় এর উদ্দেশ্য।’’ একই যুক্তি রঘুনাথগঞ্জ ১ ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি হাসানুজ্জামানের।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনও নির্বাচনের আগে ইফতার জমায়েতকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ‘ব্যবহার’ করতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘ব্লকের সব নেতার পক্ষে তো ইফতারের খরচ বহণ করা সম্ভব নয়! তাই বলা হয়েছে যাঁরা পারবেন অবশ্যই নিজের এলাকায় ইফতারের আয়োজন করুন। তার মাধ্যমে জনসংযোগ বাড়ান।’’
কংগ্রেস, তৃণমূল দুই দলই কেন্দ্রীয় ভাবে ইফতারের আয়োজনও করবে। তৃণমূল সূত্রে খবর, ১৪ জুলাই শুভেন্দু অধিকারী বেলডাঙায় ইফতার জমায়েত ডেকেছেন। সেখানে প্রতিটি ব্লকের নেতারা হাজির থাকবেন। জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র তথা সাধারণ সম্পাদক অশোক দাস জানিয়েছেন, জেলা কংগ্রেস অফিসে এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জেলাস্তরের ইফতার আয়োজিত হবে। সেখানে থাকার কথা কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরীর।
পিছিয়ে নেই বিজেপিও। দলের জেলা মুখপাত্র সুভাষ মণ্ডল জানিয়েছেন, দলের সংখ্যালঘু সেলকে ইফতারের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘‘ইসলামপুর, হরিহরপাড়া, বেলডাঙায় ইতিমধ্যেই সারা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে লালবাগে ইফতার ডাকা হয়েছে।’’
এই প্রতিযোগিতায় নেই শুধু সিপিএম। দলের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘দলের কোনও নেতাই ইফতারের জমায়েত ডাকতে পারবেন না। তবে দলের নেতা বা কর্মীরা ইফতারের আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই যেতে পারেন।’’ কেন এমন ব্যতিক্রমী অবস্থান? মৃগাঙ্কবাবুর যুক্তি, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেলানো উচিত নয়।
গোটা ব্যাপারটাকে কী ভাবে দেখছেন জেলার ইমাম ও মোয়াজ্জেন অ্যাসোসিয়েশন? সংগঠনের জেলা সম্পাদক মহম্মদ মনিরুল ইসলামের মত, ‘‘রাজনৈতিক উদ্দেশে ইফতারের ‘মজলিশ’কে ব্যবহার করা উচিত নয়। যাঁরা রোজা রাখেন, তাঁরাই রোজা ভাঙাতে ইফতার করার অধিকারী। অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় না।’’ তবে ওই মজলিশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের যোগদানে অন্যায়ের কিছু দেখছেন না তিনি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, সব ধর্মের মানুষের উপস্থিতি সকলের মধ্যে সম্প্রীতি ও সামাজিক সহাবস্থানকে জোরদার করে। এ জেলায় তার গুরুত্ব অনেকটাই।