মায়াপুরে যেতে ভরসা নৌকা। নিজস্ব চিত্র
উৎসবেই বাঁচে নবদ্বীপ। হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদের জীবন-জীবিকার পরতে পরতে জড়ানো বিচিত্র সব উৎসবের ঝলমলে পোশাক। চেনা পরবের ভিড়ে লুকিয়ে থাকে আরও কত অচেনা পার্বণ। কিন্তু উৎসব আর তাকে কেন্দ্র করে পর্যটন নবদ্বীপের মুখ্য জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বেশি দিনের কথা নয়।
কিন্তু পর্যটনকে অর্থনীতির কেন্দ্রে রাখতে গেলে যে সব আবশ্যিক শর্ত থাকে, তা পূরণ করার ক্ষমতা কি নবদ্বীপের আছে?
একটা সময় ছিল যখন গোটা পূর্ব ভারত জুড়ে নবদ্বীপের তন্তুজ পণ্যের বিস্তার ঘটেছিল। কিংবা তারও আগে কাঁসা-পিতল বা শঙ্খের শিল্প ছিল এ শহরের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। মধ্যযুগে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। পরবর্তী সময়ে কখনও গঙ্গার গতি পরিবর্তন, কখনও বা দু’কূল ভাসানো বন্যা, কখনও বদলে যাওয়া সময়ের নিজস্ব নিয়মেই নবদ্বীপের অর্থনীতির সেই সব ক্ষেত্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রায় মৃতনগরীর চেহারা নিতে থাকে একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। সেই গতিহীন অর্থনীতির পালে নতুন করে হাওয়া লাগল যখন গঙ্গার পূর্ব পারে মায়াপুরে মন্দির গড়ে তুলল ইস্কন। সাগরপারের মানুষজনের আনাগোনা শুরু হল। সময়টা সাতের দশকের প্রথম দিক। উপার্জনের নতুন রাস্তা চিনতে নবদ্বীপ ভুল করেনি। আর তখন থেকেই পর্যটন ও উৎসবকে আঁকড়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে।
এখন তেরো পার্বণের এই শহরের নিজস্ব ক্যালেন্ডারে পয়লা বৈশাখ থেকে চৈত্র সংক্রান্তি— কোনও না কোনও উৎসব বছরভর লেগেই আছে। সেই টানেই সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে ছুটে আসেন বর্ষা কিংবা বসন্তে। তাতে ভর করেই এ শহর করে ফেলেছে রুটি-রুজির স্থায়ী বন্দোবস্ত। উৎসব কেন্দ্রিক পর্যটনকে ঘিরে বাঁচার স্বপ্ন বুনতে শিখেছে।
কী নেই সেই তালিকায়? দোল বা রাস তো বটেই, একে-একে যোগ হয়েছে রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, তর্পণ এমনকি গুরুপূর্ণিমাও। বড়দিন বা নববর্ষের ভিড় ফি বছর আগের বারকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। গোড়ায় এই উৎসব-পর্যটনের সবটাই ছিল মায়াপুরের ‘সাহেব মঠ’-কেন্দ্রিক। কিন্তু ইস্কন প্রতিষ্ঠার অর্ধশতক পার করে পার্বণের নবদ্বীপ নিজে ক্রমশ উপার্জনক্ষম হয়ে উঠছে। শহরের দেড়শতাধিক মঠ-মন্দিরের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগদানে শহরের উৎসবের চরিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
এমনিতে চৈতন্যভূমির বেশির ভাগ উৎসবের কেন্দ্রে অনিবার্য ভাবেই তিনি উপস্থিত। তাঁর জন্মতিথি থেকে বিবাহ, অন্নপ্রাশন থেকে জামাইষষ্ঠীর মতো লৌকিক আচারও উপস্থাপনার মোড়কে এখন আগের চেয়ে অনেক চকচকে। যার সুফল ঘরে তুলছেন ব্যবসায়ী-সহ সব শ্রেণির মানুষ।
কিন্তু পুরোদস্তুর পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে গেলে যে রকম পর্যটক-বান্ধব হয়ে উঠতে হয় শহরকে, ধর্মীয় উৎসবের গণ্ডী পার করে ইতিহাস ও সংস্কৃতির যে বাঁধনে অপরিচিতদের জড়িয়ে নিতে হয়, তার জন্য কি এ শহর প্রস্তুত? (চলবে)