গত বছরের এই ভিড়ের দৃশ্যই বলে দিচ্ছে সাঙের ঝুঁকি কতটা। ফাইল চিত্র
করোনা অতিমারির প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অসচেতন কিছু মানুষের আবেগের সামনে চাপে পড়ে যাচ্ছে বহু মানুষের সদিচ্ছা।
হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, আপাতত কোনও পুজোয় কোনও রকম শোভাযাত্রা করা যাবে না। সেই নির্দেশ হাতে পাওয়ার পর কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের অন্যতম আকর্ষণ ‘সাং’ (বেহারা বাহিত প্রতিমা) বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। কিন্তু যত দিন এগিয়ে আসছে, নাগরিকদের একাংশের ‘আবেগ’ আর বাধ মানছে না। ঐতিহ্য’-এর ধুয়ো তুলে খোদ আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার দিকে পা বাড়াতে পারে কিছু পুজো কমিটি, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
করোনাকালে এমনিতেই কমবয়সিরা তুলনায় বেপরোয়া। কারণ তাদের জীবনের ঝুঁকি কম, তাদের কারণে বাড়ি বা পাড়ার বয়স্কদের ঝুঁকি হতে পারে এই চিন্তাকেও আমল দিতে নারাজ এদের একাংশ। এই অংশটিই বিশেষ করে সাঙের জন্য মরিয়া। মূলত এদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই ভিতরে-ভিতরে সাং বার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিছু বারোয়ারি। ফলে পুলিশ ও কিছু পুজো কমিটির লোকজনের সংঘাত প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠছে।
প্রথম দিকে কিন্তু বেশির ভাগ বারোয়ারি সাং বার না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চাষাপাড়া বা কাঁঠালপোতার মতো বড় পুজোগুলি প্রতিমা বহনের জন্য চাকাগাড়ির ব্যবস্থাও করে ফেলে। কিন্তু যত সময় গিয়েছে, নানা এলাকায় সাং নিয়ে উসকে উঠেছে ‘আবেগ’। এর মধ্যে কালীপুজোর ভাসানে হরিজনপল্লি বারোয়ারি নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে সাঙে প্রতিমা নিরঞ্জন করে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। কিন্তু এর পরেই বায়োয়ারিগুলির উপরে চাপ বেড়েছে। যে শিক্ষিত সচেতন নাগরিকেরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং আইনকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, তাঁরাও এখন হরিজনপল্লিকে দেখে ‘শিখছেন’। কিছু বারোয়ারি কর্তা এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, পুলিশ যদি মামলা করে তা হলেও তাঁরা সাং বার করবেন।
তবে সকলেই যে নাগরিকের কর্তব্যবোধ বিস্মৃত হয়েছেন, তা-ও নয়। অনেকেই মনে করছেন, এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রতি দিন লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে মৃত্যুও। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত শুধু কৃষ্ণনগর শহরেই আক্রান্ত হয়েছেন ৭৬৩ জন, মৃত ১২। প্রবীণ নাগরিক স্বদেশ রায় বলছেন, “এমনটা তো নয় যে বরাবরের জন্য সাং বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের জীবনের কথা ভেবে এক বার সাং বন্ধ রাখলে ঐতিহ্যের কোনও অবমাননা হবে না।” তাঁর মতো অনেকেই স্মরণ করছেন, শুধু নদিয়া জেলায় নয়, কলকাতা তথা গোটা রাজ্যে দুর্গা ও কালীপুজোয় যথেষ্ট সংযত থেকেছেন নাগরিকেরা। ঠাকুর দেখতে যাওয়া থেকে বিসর্জনের শোভাযাত্র, প্রায় পুরোপুরি মুলতুবি থেকেছে। দীপাবলিতে বাজি প্রায় পোড়েইনি। সেখানে শিক্ষিত সচেতন মানুষের শহর বলে পরিচিত কৃষ্ণনগর এক বার সাং বন্ধ রাখতে পারবে না?
করোনাজনিত অসুস্থতায় সদ্য ভূমিপুত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হারানো কৃষ্ণনগরে এই প্রশ্নও কিন্তু জোরালো ভাবেই উঠছে।